দল গুছিয়ে আন্দোলনের কথা ভাবছে বিএনপি। সেক্ষেত্রে দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণসহ দেশের অন্য মহানগর ও বৃহত্তর জেলাগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে ‘বড় ধরনের’ পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তবে ঢাকার বিষয়ে বেশ সতর্ক দলের শীর্ষমহল। কারণ এবার ঢাকায় ব্যর্থ হলে দলকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে মনে করছে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। এই অবস্থায় হাবিব উন নবী খান সোহেলের পরিবর্তে আমান উল্লাহ আমানকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতৃত্বে আনার কথা ভাবা হচ্ছে।

মূল দল বিএনপির পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের তৃণমূল পর্যায়ে ওয়ার্ড থানা জেলা ও মহানগর কমিটি গঠনের কাজ বেশ দ্রুতগতিতে চলছে। দল গোছানোর পাশাপাশি ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বাইরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থায় নতুন নির্বাচন দাবিতে রাজপথে একই মঞ্চে অথবা যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি করা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ইতোমধ্যে ঐক্যের প্ল্যাটফরম তৈরির জন্য খসড়া সুপারিশমালাও তৈরি করা হয়েছে। সরকারে গেলে কী-কী করা হবে তারও একটা খসড়া করা হয়েছে। ইতোধ্যে দলটির নেতারা ভার্চুয়াল সভায় ঘোষণা দিয়েছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন ও প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন করবে এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক, সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করবে। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করতে দিবে না বলে জোরালো অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।

গত শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে দল পুনর্গঠন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ‘সরকার ও নির্বাচন কমিশন’র ভূমিকা, আন্দোলন, বৃহৎ ঐক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই বৈঠকে স্থায়ী কমিটির নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার ও নির্র্বাচন কমিশনের ভূমিকার পর নির্বাচনে যাওয়ার কোনো মানে হয় না; বরং প্রতিটি নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির সবাই একমত পোষণ করে বলেন, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে দেশের আর কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনই একমাত্র পথ।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরদিন গত রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক নাগরিক ঐক্যের এক আলোচনাসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য রাখেন। ওই অনুষ্ঠানে জোটের বাইরের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকিও অংশ নেন।

এই অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে। এই ঐক্যকে আমরা বৃহত্তর করতে চাই। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট জাতীয় নেতারা রয়েছেন। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই, ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের যে প্রত্যাশা, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও ’৬৯ সালের গণআন্দোলনে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশাকে পূরণ করতে সত্যিকার অর্থেই একটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারকে পরাজিত করি বা তাদের সরে যেতে বাধ্য করি।’ একই অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই সরকার গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকার দেবে না। আসুন আরও বৃহত্তর ঐক্য করি। এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে অথবা নিজেদের মঞ্চ থেকে যুগপৎ আন্দোলন করি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পর্যায়ের একাধিক নেতা প্রায় একই মতামত প্রকাশ করে আমাদের সময়কে বলেন, ‘আসলে আমরা ভুলের মধ্যে আছি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন কেমন হবে-তা বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে তার জামিন না হওয়া থেকেই বোঝা গেছে। এরপর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ‘দিনের ভোট রাতে হলো’। প্রতিবাদে দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি করতে পারিনি। এর মধ্যে জোটের মতামত না নিয়ে সংসদে যোগদান তাও ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এত কিছুর পরও সরকার ও নির্বাচন কমিশনের স্বরূপ উন্মোচন করতে উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণও দলের ভুল সিদ্ধান্ত। এসব নির্বাচনে কী পরিমাণ অনিয়ম হচ্ছে- তা দেশের মানুষ ভালো করে জানেন। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তো কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতার ওপর চরমভাবে নাখোশও তৃণমূল।’ এসব নেতা তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এখনো সময় আছে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে দলকে সঠিক পথে আনা উচিত।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনে নামার আগে বিএনপির বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা কমিটি ঢেলে সাজাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি গঠন নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলকে সরিয়ে দেওয়া হলে দক্ষিণের কমিটির শীর্ষ পদে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানকে দেখা যেতে পারে। একইভাবে বর্তমান সভাপতি এমএ কাইয়ুমকে সরিয়ে দেওয়া হলে উত্তরে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মেয়রপদে নির্বাচন করা তাবিথ আউয়ালকে দেখা যেতে পারে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত এলেই এই কমিটি প্রকাশ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে এর বাইরেও উত্তরে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব হিসেবে আলোচনায় আছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম ও মহানগর উত্তরের সহসভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন। দক্ষিণে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার ও যুবদল দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু। অবশ্য আবদুস সালামের নাম আহ্বায়ক হিসেবে দক্ষিণেও আলোচনায় আছে।

দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, সেক্ষেত্রে যাকে কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হবে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওয়ার্ড ও থানা কমিটি গঠনের পর কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে বিদায় নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে পারবেন না।

দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, হয় বর্তমান কমিটির ভেতর থেকে আহ্বায়ক কমিটি করা অথবা ঢাকার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন- এমন নেতাদের নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটি করলে তাদের পক্ষে কাজ করা সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে যোগ্য ও ত্যাগীরা ওয়ার্ড ও থানা কমিটিতে সঠিক জায়গায় স্থান পাবেন। এমন প্রস্তাব দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছেও দেওয়া হয়েছে।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, অনেক জায়গায় ১০-১২ বছর ছাত্রদলের কমিটি ছিল না বা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এখন থানা, পৌরসভা, উপজেলা ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ হয়েছে।

দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার পর সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন বিষয়ে মানববন্ধনসহ একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এখন দলের নীতিনির্ধারকরা বছরব্যাপী কর্মসূচির পরিকল্পনা করছেন। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কর্মসূচিসহ নানা ইস্যু ধরে আবার মাঠে থাকার লক্ষ্য ঠিক করছেন। এর মধ্যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বছরব্যাপী সভা-সেমিনা?রসহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে সক্রিয় থাকবে। এসব সভা-সেমিনা?রে স্বাধীনতাসংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসের পাশাপাশি বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অর্জনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবদান এবং তার দর্শন ও আদর্শকে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়। এসব কর্মসূচিতে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং বাম রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, আগামী মার্চ মাস থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচি শুরু হবে, শেষ হবে ১৬ ডিসেম্বর। সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে ইতোমধ্যে ১০টি বিভাগীয় এবং ১৫টি বিষয়ভিত্তিক কমিটি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সমন্বয় কমিটিও করা হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বিভিন্ন দেশেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

source:Amader shomoy