সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজপরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের বিরুদ্ধে এক ব্রিটিশ নারী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন। এই অভিযোগের কথা এ মাসে ফাঁস হওয়ার পর তা হতবাক করেছে অনেককে।
৩২ বছর বয়সী এই মহিলার নাম কেইটলিন ম্যাকনামারা। তিনি ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার অভিযোগের বিস্তারিত জানিয়েছেন।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেইটলিন ম্যাকনামারা ছিলেন আবুধাবীতে। সেখানে তিনি ‘হে সাহিত্য উৎসব’ আয়োজনের কাজ করছিলেন। তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬৯ বছর বয়স্ক মিনিস্টার অব টলারেন্স বা সহনশীলতা বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এক নিরালা রাজপ্রাসাদে। কেইটলিন ম্যাকনামারা জানিয়েছেন সেখানেই তার ওপর এই যৌন হামলা চালানো হয়।
মন্ত্রী শেখ নাহিয়ান আল নাহিয়ান অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তিনি আবুধাবীর রাজপরিবারের একজন সিনিয়র সদস্য। ব্রিটেনে তার যে বাড়ি আছে, সেটির দাম কোটি পাউন্ডের ওপরে।
কেইটলিন ম্যাকনামারা ব্রিটেনে ফিরে আসেন এবং গত জুলাই মাসে লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে এই কথিত যৌন হামলার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
কয়েকটি কারণে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত এখনো শুরু হয়নি। এর একটি হচ্ছে, ঘটনাটি ঘটেছে ভিন্ন দেশে, যা লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের এখতিয়ারের বাইরে। এ ঘটনার ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুলিশের কাছে কোন অভিযোগ নেই। আর যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে, তিনি যেহেতু রাজপরিবারের সদস্য, তাই তিনি ”সার্বভৌম সুরক্ষা”র অধিকার ভোগ করেন। অর্থাৎ কোন অভিযোগে তার বিচার করা যায় না।
কেইটলিন ম্যাকনামারার আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন ব্যারনেস হেলেনা কেনেডি কিউসি। বিবিসি রেডিও ফোরের ”উইমেন্স আওয়ার” অনুষ্ঠানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তিনি চান ব্রিটিশ সরকার যেন এই ঘটনার ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর চাপ দেয়। তবে তিনি স্বীকার করেন যে আইনগতভাবে এটি করা বেশ কঠিন হবে।
‘হে ফেস্টিভ্যাল’ এ ঘটনায় তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, অভিযুক্ত মন্ত্রী যতদিন তার পদে আছেন, ততদিন তারা আর আবুধাবীতে এই উৎসব করবে না।
তবে এ ঘটনার ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কেবল মন্ত্রী শেখ নাহিয়ান আল নাহিয়ানের একজন আইনজীবী এই অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন এবং এই অভিযোগ যেভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে সে ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
শেখ নাহিয়ান ১৯৯২ সাল হতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ দেশে তিনি বেশ পরিচিত এবং সন্মানিত এক ব্যক্তি। তাকে এখনো পর্যন্ত তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়নি।
কূটনৈতিক ঝড়
ব্রিটেনের সঙ্গে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এই সম্পর্কে মাঝে মধ্যেই মারাত্মক সংকট তৈরি করছে একের পর এক এধরণের কিছু ঘটনা। এবারেরটি সেরকমেরই এক মারাত্মক অভিযোগ।
উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কে এরকম অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটছে সেই ১৯৮০ সাল থেকেই। সেবছর ব্রিটেনের একটি টেলিভিশন চ্যানেল আইটিভি-তে ‘ডেথ অব এ প্রিন্সেস’ বলে এক ডকুমেন্টারি-ড্রামা দেখানো হয়েছিল। এক সৌদি রাজকুমারী এবং তার প্রেমিককে জনসমক্ষে শিরোশ্চেদ করার ঘটনা নিয়ে ছিল অনুষ্ঠানটি।
এই অনুষ্ঠান প্রচার করার পরিণামে ব্রিটেনকে সৌদি আরবের সঙ্গে প্রায় ২৫ কোটি পাউন্ডের ব্যবসা হারাতে হয়। এখন হয়তো অনেকে সেই ঘটনার কথা ভুলে গেছেন।
সৌদি আরবে এখন নারী অধিকার পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বাকি বিশ্বের অবস্থার সঙ্গে তাদের পরিস্থিতির এখনো বিরাট ফারাক।
১৯৮৪ সালে ঘটেছিল আরেকটি ঘটনা। সৌদি আরবে তৎকালীন বিদায়ী ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার জেমস ক্রেইগ এক গোপন কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েছিলেন লন্ডনে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, সৌদি সরকার হচ্ছে ‘অযোগ্য এবং তাদের চারপাশের দুনিয়ায় যা ঘটছে সেগুলো থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন, দুনিয়া সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ।’
এই অতি গোপন কূটনৈতিক বার্তাটি ফাঁস হয়ে গেল। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের জন্য এটি এক সাংঘাতিক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করলো।
২০১৮ সালে ঘটেছিল আরেক ঘটনা। সেবছর দুবাইতে পিইচডির জন্য গবেষণারত এক ব্রিটিশ ছাত্র ম্যাথিউ হেজেসকে গ্রেফতার করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ব্রিটেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কে সেটি এক বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
ম্যাথিউ হেজেসের গবেষণা ছিল আরব বসন্তের বিদ্রোহের পর আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ে। কিন্তু আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা দাবি করলেন, তারা ম্যাথিউ হেজেসের ল্যাপটপে এমন কিছু জিনিস পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে তিনি একজন গুপ্তচর। ম্যাথিউ হেজেস এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
ম্যাথিউ হেজেসকে কয়েক মাস ধরে আটকে রাখা হয়। পরে অবশ্য তাকে ক্ষমা করে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু ম্যাথিউ হেজেস অভিযোগ করেন, বন্দি থাকা অবস্থায় তাকে নির্জন কারাবাসে রেখে তার ওপর মানসিক নিপীড়ন চালানো হয়েছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এখনো মনে করে ম্যাথিউ হেজেস একজন গুপ্তচর ছিলেন। কিন্তু ব্রিটেন বলছে, তিনি গুপ্তচর ছিলেন না।
এ বছরের শুরুতে কোভিড-১৯ মহামারি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কিছু আগে লন্ডনের হাইকোর্টে শুরু হয়েছিল এক সাড়া জাগানো আইনি লড়াই। এই মামলার একদিকে দুবাইর শাসক শেখ মোহাম্মদ আল-মাখতুম। অন্যপক্ষে তার সাবেক স্ত্রী , জর্ডানের প্রিন্সেস হায়া।
শেখ মোহাম্মদ আল-মাখতুমের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল প্রিন্সেস হায়া যেসব গুরুতর অভিযোগ এনেছেন সেগুলি যেন প্রকাশ না পায়। কিন্তু আদালতের বিচারকদের রায় গেল তার বিপক্ষে।
এই রায়ের পর ৭০ বছর বয়সী শেখ মোহাম্মদ আল মাখতুম, যিনি ঘোড়দৌড়ের জগতে খুবই বিখ্যাত, তার ব্যাপারে অনেক গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেল। বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাগুলোর একটি হচ্ছে ব্রিটেনের অ্যাসকট। প্রতিবছর সেখানে শেখ মোহাম্মদকে দেখা যায় ব্রিটেনের রাণীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে।
হাইকোর্টের রায়ের পর বিশ্ব জানতে পারলো, শেখ মোহাম্মদের দুই কন্যা যখন পরিবার ছেড়ে পালাতে চেয়েছিল তখন কীভাবে তিনি তাদের অপহরণের পর অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন।
লন্ডনের হাইকোর্টের বিচারক শেখ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে রায়ে আরও বলেছিলেন, তিনি তার সাবেক স্ত্রীকে ভয় দেখানো এবং হয়রানির জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন। প্রিন্সেস হায়া এরপর গত বছর তার সন্তানদের নিয়ে ব্রিটেনে পালিয়ে আসেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি তার জীবন নিয়ে শংকিত।
এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর সেটি বিশ্বে ঘোড়দৌড়ের জগতে বিরাট আলোড়ন তুলেছিল। তখন কেউ কেউ এমন দাবিও তুলেছিলেন, শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে যেন সবাই সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
ব্রিটেনের সঙ্গে ছয়টি উপসাগরীয় দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত সম্পর্ক সৌদি আরবের সঙ্গে। সৌদি বিচার ব্যবস্থা খুবই অস্বচ্ছ, স্বেচ্ছাচারী এবং সমালোচিত। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ উঠেছে। অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থা এরকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে।
কিন্তু ব্রিটিশ শাসনযন্ত্র পরিচালিত হয় যে হোয়াইটহল থেকে, সেখানকার নীতিনির্ধারকরা সৌদি আরবকে দেখেন ভিন্ন আলোকে। তারা মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ঠেকাতে সৌদি আরবই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা প্রাচীর।
এছাড়া উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোতে কাজ করেন হাজার হাজার ব্রিটিশ নাগরিক। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে।
ইয়েমেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সৌদি রাজকীয় বিমান বাহিনী যেসব হামলা চালিয়েছে, সেখানে তারা ব্যবহার করেছে ব্রিটেনের বিক্রি করা যুদ্ধ বিমান এবং বোমা। এই যুদ্ধ যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে তা জাতিসংঘের বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর মানবিক বিপর্যয়।
তবে যে ঘটনাটি বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছিল সেটি হচ্ছে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যাকান্ড। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তাকে হত্যা করা হয়েছিল ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে। হত্যার পর তার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। তার দেহাবশেষ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে, এই ঘটনা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের যোগসাজশে হয়েছে এমন সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। তবে তিনি একথা অস্বীকার করেছেন।
গত জুলাই মাসে সৌদি আরব এই ঘটনার জন্য ২০ জন সৌদি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌদি আরবের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কে কোন ধরণের ছেদ ঘটতে দেখা যায়নি।
আকাশচুম্বী বিত্তের প্রভাব
এতরকম কেলেংকারি যে ব্রিটেনের সঙ্গে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কোন বিরূপ প্রভাবই ফেলে না তার অনেক কারণ আছে। এই সম্পর্ক যেন সামনের দিনগুলোতে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি না হঠাৎ করে ব্রিটেন তার নীতি পুরোপুরি বদলে ফেলে।
মধ্যপ্রাচ্যে যে চলমান অস্থিতিশীলতা, যেখানে ইরান এবং ইসলামিক স্টেটকে ব্রিটেন তার জন্য নিরাপত্তা হুমকি বলে মনে করে, সেখানে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর রাজতন্ত্রকে দেখে তার প্র্রয়োজনীয় মিত্র হিসেবে।
ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো নিয়মিত উপসাগরীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে উড়ে যায়। বাহরাইনে তো ব্রিটেনের একটি স্থায়ী নৌ ঘাঁটি আছে- এইচএমএস জুফাইর।
কাতারের সঙ্গে ব্রিটেনের টাইফুন যুদ্ধ বিমানের একটি যৌথ বহর আছে। ওমানও ব্রিটেনকে অনেক ধরণের সামরিক স্থাপনা ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে। ব্রিটেন সেগুলো ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার করছে।
আর তেল এবং গ্যাস বিক্রির অর্থে উপসাগরীয় দেশগুলো যেরকম বিপুল বিত্তশালী হয়ে উঠেছে, সেই কারণতো আছেই।
এক সঙ্গে এই ছয়টি উপসাগরীয় দেশের যে বাজার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে তারাই ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। এসব দেশ থেকে ব্রিটেনে বিনিয়োগ করা হয় শত শত কোটি পাউন্ড। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি সংবাদপত্র ‘দ্য ন্যাশনাল’কে দেয়া সাক্ষাৎকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন স্বীকারও করেছেন, এই অঞ্চলটি ব্রিটেনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কাজেই এরকম একটা পরিস্থিতিতে নিশ্চিত করে দুটি জিনিস বলা যায়। প্রথমটা হচ্ছে, এরকম আরও অনেক ঘটনার কথা ফাঁস হতে থাকবে। আর দ্বিতীয়ত: উপসাগরীয় আরব দেশগুলো তাদের ভাবমূর্তি ঠিক রাখার জন্য যেসব পাবলিক রিলেশন্স কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়, আরও বহু বছর ধরে তারা ভালোই ব্যবসা করে যেতে পারবে।
Source:BBC