স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে (সিএমএসডি) নতুন দুই শতাধিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) শয্যা গোডাউনে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে। অথচ দেশের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীরা আইসিইউ শয্যা পাচ্ছে না। হঠাৎ কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখানে সরকারি তিনটি এবং বেসরকারি দুটি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। একইভাবে ঢাকার বাইরে দুটি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন আইসিইউতে রোগীপ্রতি ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এ কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর চাহিদা অনেক। দরিদ্র মানুষ আইসিইউর জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছে। আইসিইউ না পেয়ে কারও কারও মৃত্যুরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর বাইরেও কয়েকটি হাসপাতালে আইসিইউ সংকটের তথ্য মিলেছে। করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও আইসিইউর চাহিদা বেড়েছে। তবে উচ্চ ব্যয়ের বেসরকারি আইসিইউর সেবা নেওয়া দরিদ্র মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
এ অবস্থায় আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি হলে যে টাকা ব্যয় হয় তাতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের পক্ষে সেই সেবা নেওয়া সম্ভব নয়। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের আইসিইউ তাদের ভরসা। সেই সেবা নেওয়ায় আরেকটি বাধা ক্ষমতাবানদের তদবির।
সিএমএসডিতে পড়ে আছে আইসিইউ শয্যাসহ করোনা চিকিৎসাসামগ্রী :সিএমএসডি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২১২টি ফাইভ ফাংশনাল আইসিইউ শয্যা, ৪১৩টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ১৫০টি ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর প্রায় দুই হাজার এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে সাড়ে আট হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণের পর আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেন্টেটর এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট দেখা যায়। বিশেষ করে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে তীব্র সংকট দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত করোনা চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস সামাল দিতে দেশে দেশে সংকটের সৃষ্টি হয়। বিশ্ব অনেকাটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জুলাই থেকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি করে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সার্বিক বিষয়ে সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান সমকালকে জানান, করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে উন্নতমানের ফাইভ ফাংশনাল আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাই ফ্লু ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে সিএমএসডিতে মজুদ করা হয়েছে। করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চাহিদার আলোকে এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। যখনই চাহিদা আসবে সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। তবে চাহিদাপত্র না এলে সিএমএসডি নিজের ইচ্ছায় কোনো যন্ত্রপাতি হাসপাতালে সরবরাহ করতে পারে না।
পরিচালক আরও বলেন, করোনা মোকাবিলার জন্য সিএমএসডিতে যেসব যন্ত্রপাতি মজুদ আছে, তা দিয়ে আগামী দুই বছর সারাদেশে সরবরাহের চেইন অব্যাহত রাখা যাবে। এর বাইরেও যখনই হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসার জন্য কোনো উপকরণ কিংবা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে, সিএমএসডি তা সরবরাহ করে যাবে। সুতরাং কোনো সংকট নেই বলে তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৪ জুন পর্যন্ত দেশে করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ছিল ৪৫৯টি। সর্বশেষ হিসাবে মাত্র ১২৩টি বেড়ে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮২টিতে। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বেড়েছে ৭৮টি। তিনশর মতো ফাইভ ফাংশনাল আইসিইউ শয্যা কিনেছিল সিএমএসডি। সেগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৭৮টি।
রাজধানীর তিন সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই, দুটিতে শুরু থেকেই আইসিইউ নেই :দেশের প্রথম করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে আইসিইউর ১৬ শয্যা, পাঁচশ শয্যা কুর্মিটেলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ শয্যা এবং বিএসএমএমইউর ১৬ শয্যার একটিও ফাঁকা নেই। আড়াইশ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৬ শয্যার মধ্যে পাঁচটি ফাঁকা, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ছয় শয্যার মধ্যে তিনটি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (ইউনিট-২) ও বার্ন ইউনিটে ২৪ শয্যার মধ্যে তিনটি, পাঁচশ শয্যার মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৪ শয্যার মধ্যে তিনটি এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৫ শয্যার মধ্যে একটি শয্যা ফাঁকা আছে। করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। সব মিলে রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ১০ সরকারি হাসপাতালে ১১৭টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ফাঁকা আছে মাত্র ১৫টি।
বেসরকারিতেও আইসিইউ পেতে উপচেপড়া ভিড় :উচ্চ ব্যয় হওয়ার পরও বেসরকারি হাসপাতালেও উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। রাজধানীর কভিড ডেডিকেটেড বেসরকারি ৯ হাসপাতালে ২৯০ শয্যার মধ্যে ফাঁকা আছে মাত্র ৮৬টি। বাকিগুলোতে রোগী ভর্তি। ইবনে সিনা ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১০ শয্যার মধ্যে পাঁচটি, আসগর আলী হাসপাতালে ৩২ শয্যার মধ্যে ১২টি, স্কয়ারে ২৫ শয্যার মধ্যে ১৬টি, ইউনাইটেডে ২২ শয্যার মধ্যে ৯টি, এভারকেয়ারে ২০ শয্যার মধ্যে তিনটি, ইম্পালসে ২৫ শয্যার মধ্যে ১৭টি এবং এ এম জেড হাসপাতালে ২১ শয্যার মধ্যে নয়টি ফাঁকা আছে।
ঢাকার বাইরেও সংকট :ঢাকার বাইরেও আইসিইউ শয্যা নিয়ে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামের বিআইটিআইটি এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১০ শয্যার মধ্যে ছয়টি, আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ১০ শয্যার মধ্যে তিনটি ফাঁকা আছে। এর বাইরে সারাদেশে ২৪৭ আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১৭২টি ফাঁকা আছে।
আইসিইউ নিতে আগ্রহী নয় সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ :চাহিদা থাকার পরও সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কেন আইসিইউর চাহিদা পাঠাচ্ছে না- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, জনবল সংকটের কারণেই চাহিদা থাকার পরও মূলত আইসিইউ শয্যা নিতে আগ্রহী নয় সরকারি হাসপাতালগুলো। এর বাইরে অবকাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর কভিড-১৯ ডেডিকেটেড একটি সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ সমকালকে বলেন, আইসিইউ শয্যা থাকলেই তো হবে না। এই শয্যা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন ও অ্যানেসথেশিয়ায় উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন চিকিৎসক প্রয়োজন। দেশে এ বিষয়ের চিকিৎসক সংকট রয়েছে। একই সঙ্গে আইসিইউর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ নার্স প্রয়োজন। তাদের সংখ্যাও অপ্রতুল। এ কারণে রোগীর চাহিদা থাকলেও আইসিইউর শয্যা বাড়ানো সম্ভব নয় বলে জানান ওই চিকিৎসক।
অপর তিনটি সরকারি হাসপাতালের অন্তত পাঁচজন চিকিৎসক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাহিদা না দিলেও সিএমএসডি অতীতে সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। এখন আইসিইউ শয্যার জন্য তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা চাইছেন, এটি অমূলক। বর্তমানে কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে যত সংখ্যক আইসিইউ আছে, সেগুলো পরিচালনার জন্যই পর্যাপ্ত জনবল নেই। এর ওপর আরও শয্যা বাড়ানো হলে তা চালানো সম্ভব হবে না। এর বাইরে অবকাঠামোগত সংকটও রয়েছে। কারণ আইসিইউ ব্যবস্থাপনার জন্য কক্ষ তৈরি করতে হয়। যেটি সময় সাপেক্ষ। এসব কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বাড়তি আইসিইউ নিতে আগ্রহী নয়, আবার বর্তমান বাস্তবতায় সিএমএসডিও কোনো হাসপাতালকে আইসিইউ গছিয়ে দিতে পারছে না বলে জানান তারা।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। আশঙ্কা করেছিলাম, শীতের শুরুতেই রোগী বাড়বে। তবে দেখা যাচ্ছে, করোনা আক্রান্ত কমছে। হাসপাতালে সাধারণ শয্যার অধিকাংশ এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। আইসিইউর চাহিদা গত কয়েক দিন ধরে বাড়ছে। সিএমএসডিতে এখনও ২০০’র ওপরে আইসিইউ শয্যা মজুদ আছে। সেগুলো কীভাবে বণ্টন করা যায়, তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে। আবার অনেক হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। আগে ১০ লিটারের মতো অক্সিজেনের প্রয়োজন হলেই রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন হতো। তবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনের কারণে ৫০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হলেও রোগীকে ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। এর পরও সম্ভাব্যতা যাচাই করে মজুদ থাকা আইসিইউ শয্যা হাসপাতালগুলোতে বণ্টন করা হবে বলে জানান তিনি।

Source:Somokal