স্টাফ রিপোর্টার
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ জুলাই – অগাস্টের মধ্যেই বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) দলটির চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এটা গণতন্ত্রের সবচেয়ে ইম্পোর্টেন্ট বিষয়। সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই অগাস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এ কারণে আমরা সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।

এর আগে গত ১৬ ই ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথম দিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এদিকে, ওইদিন দুপুরেই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির অগাস্টে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে করা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার কোনো মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রস্তুতিটা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় যে উইনডোটা দিয়েছেন সেই উইনডোটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না অবশ্য বলছেন, নির্বাচনের জন্য সরকারকে কোন চাপ তারা দিচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় সংস্কার করেও নির্বাচন করা সম্ভব এবং সেটা দ্রুতই সম্ভব। এজন্য আমরা কোন চাপ দিচ্ছি না। একটা গ্রহণযোগ্য, কোয়ালিটি নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার সেগুলো আমরা বলবো। সরকার নির্বাচনের যে সময় জানিয়েছে তাতে কোন সমস্যা ছিল না।

যে কারণে অগাস্টেই নির্বাচন চায় বিএনপি
গত সোমবার রাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত জানাতেই গতকাল মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। স্থায়ী কমিটির সভায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার যে বক্তব্য ছিল, এই বছরের শেষের দিকে অথবা পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে … এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে গতকাল দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, এত বিলম্বিত করার কোনও কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে, গভর্ন্যান্সের মধ্যে মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। নির্বাচন সংস্কার সংক্রান্ত যে কমিটি এটার রিপোর্ট এসে যাবে কালকে। সুতরাং আমার মনে হয় না যে এটা আরও বিলম্বিত করার কোন প্রয়োজন আছে। কারণ যত বিলম্ব হচ্ছে তত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে। বারবার করে বলছি আসলে নির্বাচিত সরকারের কোন বিকল্প নেই। নির্বাচন গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ বছরের জুলাই-অগাস্টের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানান তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই অগাস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এ কারণে আমরা সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। জাতি একটা ক্রান্তিকালে অবস্থান করছে। এখন সময়টা খুবই সেনসিটিভ সময়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়, জাতি এখন একটা অত্যন্ত ক্রান্তিকালে অবস্থান করছে। এর থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে পথটা এই পথটাকে কোন ভাবেই যেন আমরা খুব বেশি বাধাগ্রস্ত না করি সেই আহ্বানটা আমাদের সকলের প্রতি থাকবে।

আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সংসদ নির্বাচন চায় না বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সংসদ নির্বাচনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এখনতো ফোকাসটা পুরো দেশের , জাতির হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপরে। ক্রাইসিসটা ওই জায়গাতেই। গত তিনটা জাতীয় নির্বাচন হতে পারে নি ফলে মানুষ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে সুগম করতে চায়। আপনাদের বুঝতে হবে স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না। দেশ চালায় কিন্তু জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ, গণতন্ত্রের মূল বিষয়টা হচ্ছে জাতীয় সংসদ। এটা কার্যকর হলে গণতন্ত্র ফাংশনাল হয়।

এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান জানান, গত পাঁচ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করেনি। এই সরকার তো আজকে পাঁচ মাসের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদটা বাতিলও করে নাই। কাজেই এখানে যে লোকাল গভর্নমেন্টের নির্বাচন করবো, ইউনিয়ন পরিষদ বাদ দিয়ে তারপরে ওপরের দিকে? পৌরসভা বলুন, উপজেলা বলুন , সেটাতো আরও ওপরে। কাজেই একদম তৃণমূলের যে লোকাল গভর্নমেন্ট সেটাতো ইউনিয়ন পরিষদ, সেটা যদি বাতিলই না করা হয়ে থাকে তবে এখানে নির্বাচন কিভাবে?

অন্য নির্বাচনের চিন্তা আসে কোত্থেকে?
নির্বাচনের জন্য কতগুলো আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, যেমন ভোটার লিস্ট। ভোটার লিস্টতো রেডি। এটা বেশি দিন লাগার কথা না। যদি হালনাগাদ কেউ করতে চায় এক মাসের মধ্যে করতে পারবে। নির্বাচনের প্রিজাইডিং অফিসার তৈরি করা এটার জন্য এক – দুই মাসের বেশি সময় লাগার কথা না। সুতরাং সবইতো তৈরি আছে। নির্বাচন কমিশনও বলেছে আমরা রেডি, নির্বাচন করার জন্য আমরা তৈরি আছি এবং তারা জাতীয় নির্বাচন করার জন্য রেডি আছে। তারা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে দুটো নির্বাচন একসাথে সম্ভব না। আমি মাঝে মাঝে অবাক হই এরকম একটা ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া অন্য নির্বাচন করার চিন্তাটা আসে কোত্থেকে? নির্বাচন পেছানোর চিন্তাটাই বা আসে কোত্থেকে?

সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করেমির্জা ফখরুল বলেন বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ফ্যাসিস্টের বিচারও করা হবে তবে তড়িঘড়ি করলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সুতরাং আমরা ফ্যাসিস্টের বিচার করবো না তো কে বিচার করবে? যদি আমরা ক্ষমতায় আসি। যেটা শুরু হয়েছে এখান থেকে সরে যাওয়ার কারও কোন উপায় নেই। অবশ্যই বিচার করতে হবে। আবার বিচার তড়িঘড়িও করা যাবে না। তড়িঘড়ি করলে বিচার কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং এটা একটা প্রক্রিয়া। এটা চলবে এবং এটাকে আমরা অবশ্যই শেষ করবো। একইসাথে জামায়াতে ইসলামীও গত কয়েকদিন আগে দ্রুত নির্বাচন দাবি করেছে।

তবে, এ বিষয়ে কথা বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেলকে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।

সংস্কার শেষেই নির্বাচন
প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নতুন সংবিধান রচনা করার পর নির্বাচন চায় চব্বিশের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে, ভারতের সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যের পরদিনই বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবি একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, ভারতও চাপ দিচ্ছে যে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন দরকার। সংস্কার ছাড়াই। আজকে হঠাৎ করে বিএনপি ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে, এতোদিন যাবৎ ২০২৫ সালের মধ্যে দিতে বলছে। এই দুটোর মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি। ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিএনপি এটা চাচ্ছে। ভবিষ্যতে আর কোন ফ্যাসিস্ট যাতে আসতে না পারে সেরকম নিশ্চিত সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। নতুন একটি গণপরিষদ ও নতুন সংবিধান রচনার মাধ্যমেই সম্ভব বাংলাদেশে আর কোন ফ্যাসিস্ট আসবে না এটা নিশ্চিত করা সম্ভব। একইসাথে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানান। বিএনপি চাচ্ছে ক্ষমতায় এসে নিজেদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেবে। এটাকে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টায় আছে। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করেই জাতীয় নির্বাচন বা গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে এগোনো যায়।

সূত্র : বিবিসি বাংলা