জয়নাল আবেদিন
ধরে নিলাম গার্মেন্টস খুলে দেয়া খুব খুব জরুরি ছিল। তাই বলে এই হাজার হাজার মানুষের হাতে এক ধরণের মৃত্যু পরোয়ানা তুলে দেয়াটা কতটা মানবিক হয়েছে?
হতাশ, হতাশ, হতাশ! মাওয়া ঘাটের ছবি আর পায়ে হেঁটে ঢাকাগামী মানুষের স্রোত দেখে আমি হতাশ। এই সময়ে গার্মেন্টস খুলে দেয়া কতটা জরুরি এবং এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতটা সেই প্রশ্নের জবাব আমি জানি না। তবে এটা জানি পুরো বিশ্ব এখন স্থবির। কোথাও জনসমাগম নেই। মানুষ অভাবে পড়বে, চাকরি হারাবে, তৃতীয় বিশ্বে বহু মানুষ না খেয়ে মরবে, কোনো কোনো রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে- এত সব বাস্তবতা সামনে রেখেও পুরো দুনিয়া লক ডাউনে।
কারণ সবার আগে মানুষের জীবন। গার্মেন্টস খুলে দেয়া কতটা জরুরি ছিল আমি জানি না। ধরে নিলাম গার্মেন্টস খুলে দেয়া খুব খুব জরুরি ছিল। তাই বলে এই হাজার হাজার মানুষের হাতে এক ধরণের মৃত্যু পরোয়ানা তুলে দেয়াটা কতটা মানবিক হয়েছে?
পায়ে হেঁটে ঢাকা এসেছে মানুষ। একে তো মৃত্যু ভয়, তার মধ্যে গরুর পালের মতো এভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা কেমন মানবতা? কোরবানির গরুকেও তো ট্র্যাকে বেঁধে হাঁটে আনা হয়। গার্মেন্টস খোলার রহস্য না হয় নাই বুঝলাম কিন্তু এভাবে দল বেঁধে পায়ে হাঁটিয়ে আনাটাকে কীভাবে জাস্টিফাই করি? যদি গার্মেন্টস খোলা বাধ্যতামূলক পর্যায়েই চলে যায় তবে মানুষগুলোকে একটা ন্যূনতম সোশ্যাল ডিস্টেন্স মানিয়ে ফেরানোর কোনো বুদ্ধিই কি ছিল না?
এক সাথে না খুলে ধাপে ধাপে খোলা যেত না? এদের জন্য আলাদা কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেত না? কোনো উদ্ভাবনী পলিসি কারো পক্ষে বের করা সম্ভব ছিল না? উত্তর যদি “হ্যাঁ” হয়, তবে কেন কিছুই করা হয়নি? দেশ লক ডাউনে রেখে কেন এই নিদারুণ রসিকতা? আর উত্তর যদি “না” হয়, তাহলে আসলে লক ডাউন খুলে দেয়া হোক। মানুষ মরার আগে বুক ভরে দম নিক। করোনা থেকে অনর্থক পালিয়ে না থেকে নিজেই কোলাকুলি করুক করোনার সাথে।
বান্দরের বাঁশ বেয়ে উঠার মতো এই করোনা প্রস্তুতিরও ইতি ঘটুক। গৃহবন্দী সময় অসহ্য, তারচেয়েও অসহ্য এসব রসিকতা দেখা। মসজিদে ম্যাস গেদারিং বন্ধের জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাবে বেশ কদিন ধরে বলে আসছিলাম। এখন থেকে এই বলাটাও অর্থহীন হয়ে গেল। গার্মেন্টসের পাশাপাশি এখন থেকে নিয়ে সীমিত আকারে (সেই সীমিত কয়শজন ঠিক নেই) মসজিদে জামাতের যে বিগঘুটে নিয়ম সেটাও তুলে নেয়া হোক। চরম অস্বাভাবিক হবার আগে অন্তত কিছুদিনের জন্য স্বাভাবিক হোক সব। করোনার ভয়ানক থাবা এদেশে না বসলেই তো ভালো, বসলেও কেউ কাউকে তখন আর দায় দিতে পারবে না।
এদেশ মৃত্যুপুরী হবার সব যোগ্যতা রাখে। যদি তেমন কিছু না হয় তবে ধরে নিতে হবে সৃষ্টিকর্তা এদেশের মানুষকে কোনো কারণে এখনো অনুগ্রহ করেন কিংবা এদেশের মানুষদের হিসেব থেকেই কেটে দিয়েছেন। এদেশের মানুষ এমন পর্যায়ে আছে যে তাদের ওপর গজব ঢালতেও সৃষ্টিকর্তার রুচি হয়নি। আমি লেখক মানুষ, বিশ্বাস করি গল্প-উপন্যাস, প্রেম-ভালোবাসার কাব্য লেখা ছাড়াও আমার সামাজিক এক টা দায় আছে। সেই দায় মেটাতে সব সময় “সদা সত্য কথা বলিবে” “অন্যকে কষ্ট দেয়া ভালো না” ধরণের সহজপাচ্য ও নির্বিবাদী কথা বললে হয় না। কিছু কিছু সময় অনেকের অপছন্দ হতে পারে এমন কথাও বলা লাগে।
এই করোনা ইস্যুতে অনেকের পছন্দ না হবার মতো বেশ কিছু কথা বলেছি। কয়েকজনকে ব্লক-আনফ্রেন্ড করেছি, আমাকেও করা হয়েছে। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এসব অসার ছিল। কোনো মানে ছিল না এগুলোর। যাই হোক, ভালো থাকেন যে যার মতো করে। নিরাপদ থাকার চেষ্টা করে লাভ আছে কিনা জানি না, তাও চেষ্টা করেন নিরাপদ থাকার। করোনার দিন শেষ হয়ে যাক।