পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে – তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডা অর্থ পাচারের যে গুঞ্জন এতদিন ছিলো তার সত্যতা পাওয়া গেছে। এর প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তারাও এনিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং এসংক্রান্ত তথ্য তারা সরকারের কাছে চেয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা হলেও, কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার বিষয় বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানান, তারা অন্তত ২৮টি ঘটনায় দেখেছেন যে যারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে টাকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাই বেশি।
এর আগে চলতি বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অর্থপাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) জানিয়েছিলো যে গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)এর তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বেশি টাকা পাচার হয়।
এভাবে নানা পন্থায় বিদেশে টাকা পাচার করে সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ আছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু পাচার হওয়া টাকার প্রকৃত পরিমাণ কত বা কারা টাকা পাচার করেছে সে ধরণের বিস্তারিত তথ্য খুব একটা জানা যায়না।
বাংলাদেশ সরকারও কখনো এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনা।
তবে ২০১২ ও ২০১৩ সালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে ২১ কোটি ৫৫ হাজার টাকা তিন দফায় দেশে ফেরত আনার পর সরকারী মহল থেকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিলো।
কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ কিভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফএফআই) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলছেন পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা দীর্ঘ ও জটিল বিষয়।
“এর সফলতার হার খুবই কম। বিশ্বজুড়ে ৩/৪ শতাংশ বলে অনেকে দাবি করে থাকেন,” বিবিসি বাংলাকে বলে তিনি।
মিস্টার হাসান বলেন অর্থপাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে এবং তিনি যেখানে পাচার করেছেন সেখান থেকে যে কোনো মাধ্যমে সঠিক তথ্যটি পেতে হবে।
পাচার যে দেশে হয়েছে সেখানকার তথ্য পাওয়ার পর দু দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পারস্পারিক তথ্য বিনিময় করবে।
“কিন্তু এসব গোপন তথ্য আদালতে দেয়া যায় না। তাই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সের অনুরোধ করতে হয়। সেটা দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের মতো করে তথ্য আনতে হয়,” বলছিলেন মিস্টার হাসান।
তিনি বলেন ওই অনুরোধের পর পাওয়া তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয় এবং সেটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে পাঠিয়ে সেখানকার আদালতেও ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয়।
আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, এ পর্যায় পর্যন্ত গেলে পাচার করা অর্থ আনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়।
তবে এরপরেও দু দেশের মধ্যে সমঝোতা ও কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয় আছে।
বাংলাদেশে আগে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মাধ্যমে করা হলেও এখন সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
“স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই সব সমন্বয় করে এখন। তারা আদালতে নিয়ে এলে সেটি আমরা দেখভাল করি,” বিবিসি বাংলাকে বলছেন তিনি।
আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলছেন যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে সেটি আদালত পর্যন্ত এলে তারপর ওই দেশ সহযোগিতা করলে টাকা ফেরত আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
” এজন্য জাতিসংঘ কনভেনশনের আওতায় কিছু পথ আছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সাথে ৭২ দেশের এফআইইউ-এর সমঝোতা আছে। এছাড়া এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১৬৫ টি দেশের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। আবার ট্যাক্স রিকভারির জন্য রাজস্ব বোর্ডের কিছু চুক্তি আছে,” বলছিলেন তিনি।
সবকিছু কাজে লাগিয়ে দেশের আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় পেলে তা যে দেশে পাচার হয়েছে সেদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে পাঠানো হয়।
ওই অর্থ ফেরত দেয়া যায় কিনা সেটি নিয়ে তারা সেখানে মামলা করতে পারে এবং এরপর ওই দেশ অর্থ ফেরত দিতে কোনো আইনি সমস্যা আছে কিনা তা পর্যালোচনা করে।
যদি পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকে, সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
আর এসব কারণেই বিষয়টি অনিশ্চিত , জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী বলে উল্লেখ করছেন আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান।
পাচার হওয়া অর্থ মামলা ছাড়া ফেরত আনা সম্ভব?
এটি সম্ভব, যদি উভয় দেশে এ নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা না থাকে।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। বাংলাদেশ এই এগমন্ড গ্রুপের সদস্য বলে জানিয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান।
এ ক্ষেত্রে এক দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অন্য দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বরসহ কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হবে।
এটি পাওয়ার পর ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তথ্য যাচাই-বাছাই করবে এবং তাতে কোনো তথ্যে গরমিল না পেলে কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।
তবে এ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।
Source:BBC