নিখোঁজ সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনা বলেছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরাই যে ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে গেছেন, এটা নিশ্চিত। আর ঘটনার পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাক্ষাতের আয়োজন এবং ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার আশ্বাস ছিল লোক দেখানো।
তিনি বলেন, ওই সময় বিএনপির পাঁচ দিন হরতাল ছিল। বিএনপির সেই হরতাল, আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্যই ছিল ওই আশ্বাস। গুম পরিবারের সদস্য মানে যেন আমরা অপরাধ করেছি।
আজ সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ‘ইলিয়াস আলীসহ সকল গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দাও’ শীর্ষক এই সভা হয়। এতে ঢাকায় যুক্তরাজ্য ও কানাডা দূতাবাসের কুটনীতিকরাও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিএনপির ৬ শতাধিক নেতাকর্মীর ‘গুম’ হওয়ার ওপর একটি ভিডিও ক্লিফ দেখানো হয়।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে বনানীর রাস্তা থেকে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে যায়। পরিত্যক্ত অবস্থায় গাড়িটি উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর থেকেই তারা নিখোঁজ।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনা বলেন, ‘বনানী দুই নম্বর রোডে আমার বাসা। আশপাশের সিকিউরিটি গার্ড, ডাব বিক্রেতা ছিল। ওই সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে ছিল, যার কথা সংবাদমাধ্যমেও এসেছিল। ধস্তাধস্তি দেখে উনি যখন গাড়ির সামনে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তখন তাকে আইন প্রয়োগকারী একটি সংস্থার কার্ড শো করা হয়েছিল যে তারা আইনের লোক।’
আক্ষেপ প্রকাশ করে তাহসীনা রুশদীর বলেন, ‘ইলিয়াস আলী গুমের পর কোনো একজন মানুষকে উনারা থানা নিয়ে গেছেন বা কোথাও নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, এ রকম কোনো ঘটনা আমরা দেখিনি। তারা নির্লিপ্ত ছিল। সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য ছিল খুবই মর্মান্তিক এবং পরিহাসমূলক। বরং ঘটনার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা ইলিয়াস আলীকে গুম করার ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার ছাপিয়ে তারা ইলিয়াস আলীকে একজন খারাপ লোক হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।’
স্বামী নিখোঁজের পর গত ১০ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তাহসীনা রুশদীর। তিনি বলেন, ‘গুম পরিবারের সদস্য মানে যেন আমরাও অপরাধ করেছি। আমাদের স্বামীকে গুম করা হয়েছে, এ অপরাধ সরকারের নয়, যেন এ অপরাধ আমাদের। সুতরাং আমাদের ছেলে মেয়েরা চাকরি পাবে না, কোথাও কাজ পাবে না। আমাদের ছেলেমেয়েদের এ দেশে বাস করার অধিকার নেই। এ রকম একটা ভাবসাব বর্তমান সরকারের এবং তাদের বিভিন্ন নেতাদের।’
সভায় নিখোঁজ সাইদুর রহমানের বাবা শফিকুর রহমান, মাজহারুল ইসলাম রাসেলের ভাই মশিউর রহমান, পারভেজ হোসেনের ছোট মেয়ে আদিবা হোসেন, নুরুজ্জামান জনির স্ত্রী মুনিয়া আক্তার, মনির হোসেনের ভাই ওবায়দুল্লাহ হোসেন তাঁদের মনোবেদনা ও আকুতির কথা তুলে ধরেন।
এই অনুষ্ঠানের সভাপতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে এখন এক ‘দমবন্ধ করা পরিবেশ’ বিরাজ করছে। প্রতিদিন মানুষের অধিকার নিয়ে মানুষ কথা বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। চারদিকে একটা ভয়াবহ অবস্থা। একটা অক্টোপাসের মতো সব কিছু দমবন্ধ করার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে এই অবৈধ সরকার।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গুম পরিবারের সদস্যদের স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নাই। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই অবস্থা থেকে যদি মুক্তি পেতে হলে বর্তমানে এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে জনগনকে রক্ষা করতে হবে। এই কান্নার শেষ দেখতে হলে এই সরকারকে বিদায় করতে হবে। তা করতে হলে এদেশের সকল গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক সকল জনগন, ব্যক্তি, দলকে সরকার হটানোর ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তা না হলে এদেশে কারো কান্না থামবে না।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এখন এতোগুলো বছর পরে এটাই হলো সত্য যে, আমরা সিন্দাবাদের দ্বৈত্যের চাইতে নিষ্ঠুর একটা দ্বৈত্যকে কাঁধে নিয়ে চলছি। না নিয়েও উপায় নেই। আমরা যদি অনেক জোরে কাঁধ ঝাঁকি দেই উনি পড়েন না, আমরা যেরকম করেই চেষ্টা করছি উনি যাচ্ছেন না। ভাববার বিষয়। তখনই বলেছিলাম, মাফ চেয়ে, হাত বদল করে যত মিনতি করেন এরা আপনাদের হারানো স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। কারণ ওরা তো নিজেরাই নিয়ে গেছে। এবং নিয়ে যে গেছে এর পেছনে লক্ষ্য ছিলো একটাই তাদের রাজনীতি, তাদের দল, তাদের ক্ষমতা পাকাপুক্ত করবে।’
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ও মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল ও ইলিয়াস আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াসের পরিচালনায় আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, গণ-অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভেকেট আসাদুজ্জামান আসাদ প্রমুখ।
আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, জয়নুল আবদিন ফারুক, শাহজাদা মিয়া, ইসমাইল জবিউল্লাহ, অধ্যাপক সাহিদা রফিক, অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, অধ্যাপক মামুন আহমেদ, শামা ওবায়েদ, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ব্যারিস্টার মীর হেলালসহ অনেকে।
source amadershomoy