সরকার হটাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের ‘রাজপথ দখলে’র প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংগ্রাম শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এ লড়াই দেশ বাঁচানোর লড়াই। গণতন্ত্র মুক্তির লড়াই। এ লড়াই আমাদের প্রাণের লড়াই, আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই। এ লড়াই বাংলাদেশকে রক্ষা করার লড়াই। এ লড়াই বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে বাঁচানোর লড়াই। দেশের সব তরুণ ও যুবসমাজকে এ লড়াইয়ে শামিল হতে হবে। যেভাবে আমরা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। আজ আপনাদের আবারও এ দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে হবে। এ সরকারকে বিদায়ের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর মাধ্যমে দেশ বাঁচাতে হবে। দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। এ লড়াইয়ে অবশ্যই আমাদের সবাইকে শরিক হতে হবে। আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। রাজপথ আমাদের দখল করতেই হবে। রাজপথের লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে অবশ্যই এ ফ্যাসিস্ট দানবীয় সরকারকে সরিয়ে সত্যিকার অর্থেই আমরা জনগণের সরকার, জনগণের রাষ্ট্র, জনগণের সমাজ তৈরি করব।
গতকাল সন্ধ্যার আগে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের নজিরবিহীন লোডশেডিং, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধিসহ সম্প্রতি ভোলায় পুলিশের গুলিতে দলের দুজন কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ আহ্বান জানান। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি যৌথভাবে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালামের সভাপতিত্বে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ও রফিকুল আলম মজনু সমাবেশ পরিচালনা করেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, আবদুল্লাহ আল নোমান, মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, জয়নাল আবেদীন, আমান উল্লাহ আমান, আফরোজা খান রিতা, রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, ডা. দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিনসহ দল ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বক্তৃতা করেন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব আশা-আকাক্সক্ষা ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। দেশের অর্থনীতিকে দেউলিয়ায় পরিণত করেছে। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণ করে ফেলেছে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে দেশের নির্বাচনীব্যবস্থা তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাতিল করেছে। এসবের মাধ্যমে তারা একটি দানব সরকারে পরিণত হয়েছে। খুন, গুম, সন্ত্রাস, গুলি, হত্যার মাধ্যমে তারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু তা আর সম্ভব হবে না। মানুষ জেগে উঠতে শুরু করেছে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। মির্জা ফখরুল বলেন, জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। গণপরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী। আপনাদের কাজকর্ম দেশের জনগণের জন্য। নিরপেক্ষভাবে আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সমাবেশ চলাকালে সমাবেশস্থলের ওপর দিয়ে ড্রোন চলার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ সরকার ইরান থেকে ড্রোন কিনে নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে ট্রেনিংও দিয়ে এনেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এগুলো নাকি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ওপর মনিটরিং করার জন্য এনেছে। কিন্তু আমরা শঙ্কিত। কারণ বিভিন্ন দেশে বিরোধী নেতাকর্মীর গতিবিধি লক্ষ্য করা এবং তাদের হত্যার জন্যই এসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সমাবেশে আসার সময় উত্তরা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতাকে গ্রেফতারের অভিযোগ করে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, আগামী ২২ আগস্ট থেকে দেশের সব উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে আমরা ছড়িয়ে পড়ব এবং সেই একইভাবে প্রত্যেকটি উপজেলা, জেলায় ও মহানগরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলে শান্তিপূর্ণভাবে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আমরা এ সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করব ইনশাআল্লাহ।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, শ্রীলঙ্কার চেয়েও আজ খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে ফোকলা করে দিয়েছে এ সরকার। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের দেশের পার্থক্য হলো, সে দেশের জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। আমরা এখনো রাস্তায় নামিনি। সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে আবদুস সালাম বলেন, আজকের সমাবেশে কয়েক লাখ নেতা-কর্মী উপস্থিত হয়েছেন। এ সমাবেশ থেকে শুরু হবে সরকার পতনের আন্দোলন।
দীর্ঘদিন পর রাজধানীতে বিএনপির শোডাউন : দীর্ঘদিন পর বিএনপি রাজধানীতে শোডাউন করেছে। বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী এতে অংশ নেন। দুপুর ১২টার আগে থেকে রাজধানীর বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ডের বিএনপি নেতাকর্মীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে আসতে শুরু করেন। নয়াপল্টন এলাকার ভিআইপি সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে সমাবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। সমাবেশস্থল ও আশপাশের এলাকায় বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। প্রস্তুত রাখা হয় প্রিজন ভ্যান, জলকামান ও সাজোয়া যান। পোশাকধারী পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক সাদা পোশাকের পুলিশও দায়িত্ব পালন করে। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আবদুল আহাদ গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে বলেন, সমাবেশ ঘিরে পল্টন ও আশপাশের এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
দুই গ্রুপের মারামারি, কয়েকজন আহত : বিএনপির সমাবেশে অংশ নেওয়া সাবেক ছাত্রদল নেতাদের দুই গ্রুপের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনের সড়কে সমাবেশস্থলে বসার জায়গা নিয়ে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের পরে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ব্যক্তিগত অফিসে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
বিএনপির সমাবেশে ড্রোন : বিএনপির এ সমাবেশ চলাকালে নয়াপল্টন পলওয়েল ও চায়না টাউন মার্কেটের আকাশে কয়েকটি ড্রোন উড়তে দেখা যায়। যদিও কে বা কারা ড্রোন উড়িয়েছে তা জানা যায়নি। সমাবেশ চলাকালে আকাশে ড্রোন ওড়ানোর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির ঢাকা উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের কোনো সংস্থা হয়তো আকাশে ড্রোন উড়িয়ে সমাবেশের উপস্থিতি দেখছে। কারণ সাধারণ মানুষের ড্রোন ওড়ানোর কোনো অনুমতি নেই।