মোস্তাক আহমেদ:

সন্দেহটা ঐদিনই পোক্ত হলো যেদিন মা-ছেলের একসাথে জ্বর এলো। তার প্রায় সপ্তাহ খানেক আগ থেকেই মেয়ে এবং আমার একসাথে সর্দি-গলায় কেমন জানি লাগছিল।সারা দিন করোনা রোগী থেকে শুরু করে শপিং মল পরিদর্শন, বাজার ব্যবস্থাপণা, ত্রাণ বিতরন কতো কি! কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবো নিজেকে নিজেই সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু এতোসব কিছুর মাঝেও যথাযথ স্বাস্হ্য সামগ্রী নিয়ে অফিস কাজ সবই করতে হচ্ছে। মনে মনে কয়েকবার পরীক্ষা করার চিন্তা আসলেও সুষ্পষ্ট লক্ষণ না থাকায় নিজেকে বিরত রাখলাম কেননা সহস্রাধিক অফিসার- ফোর্স আমার সাথে কাজ করে তাদের মনোবল অটুট রাখতে সবাই মিলে রাতদিন যেভাবে কাজ করছি তাতে যাতে ভাটা না পড়ে। কিন্তু মা-ছেলের একসাথে জ্বর আসায় একটু বিচলিত হয়েই পরলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষাটা করবো এবং কালই, কারন পরিবারের সদস্যরা বাহিরে বের হয়না আমিই বের হই, ওদের কারো হলে আগে আমারই হবে । সবাই মিলে পরীক্ষা করার আগে সবার মনোবল দৃঢ় রাখার জন্য কত চেষ্টাই না করলাম! কারন কাল যদি কারো পজিটিভ আসে তাহলে কিভাবে সবকিছু সামাল দিব? অবশেষে রেজাল্ট পেলাম আমার স্ত্রীর পজিটিভ বাকী সবার নেগেটিভ। শুরু নতুন অধ্যায়।


বাসার সবাই স্বাভাবিক চলাফেরার মাঝেই খবরটা পেলাম। আগে থেকে সবাইকে মানসিকভাবে তৈরী করে রেখেছিলাম বলে প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে আমার স্ত্রীকে আইসোলেনের কাজ টুকু করলাম। পুরো ঘরটাকে ডিজইনফেক্টেড করা সহ প্রাথমিক কাজ টুকু সারলাম। আমার যারা কাছে থাকেন তাদের দিয়ে তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো আনিয়ে নিলাম।মন যতই শক্ত রাখলাম আস্তে আস্তে কোথায় যেন একটু ভয়ও পেতে লাগলাম। বাচ্চাদের মনেও আস্তে আস্তে কেমন বিষাদের ছায়া দেখতে পেলাম। নিজের চাকরির ধরনের কারনে বাচ্চাদের কখনো সময় দিতে পারিনি বলে ওরা আমাকে গভীর রাতের আগে দেখবে আশাও করেনা, কিন্তু ওদের মাকে ছাড়া ওরা এক মূহূর্ত কখনো থাকেনি। ওদের মা জীবনে অনেক প্রোগ্রামে যায়নি শুধু বাচ্চারা যেতে পারবেনা বলে , যদিও যায় প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় খবর নেয় । জীবনে এই প্রথম দেখলাম ওরা এতোটা অসহায়। করোনা বিষয়ক কোন হতাশার খবর শুনলে মেয়েটা শুধু অসহায় ভঙ্গীতে বলে ‘এটা কোন কথা’।
প্রথম দিন আমার স্ত্রীর খুব স্বাভাবিক ভাবে কাটলেও বুঝতে পারছিলাম দ্বিতীয় দিন থেকে ভয়ে ভয়ে আছে , রাতে নাকি বূকটা ভারী লাগছিল। আমাকে না জানিয়ে নিজে নিজে ব্যায়াম করে, ভাঁপ নিয়ে , লেবু- গরম জল খেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু আমি ভয় পাবো বলে আমাকে বলেনি। পরদিন বারবার মন খারাপ কেন জিজ্ঞেস করাতে বলে এই কথা । একটু বিচলিতই হলাম কিন্তু তাকে বুঝতে না দিয়ে এদিকে এসে নিউইয়র্কের ডাক্তার ফেরদৌস ভাইকে ফোন দিলাম। বললো ভাবীকে ফোন দে। ফোন কাছে গিয়ে লাউড স্পীকার এ দিয়ে সব শুনে কিছু পরামর্শ দিয়ে আমাকে বললেন ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু ততোক্ষণে নেট দুনিয়ার তথ্য ঘেটে দুজনেই বুঝে গিয়েছি ভয়ের যেকোন কিছু যেকোন সময়ই হতে পারে। আমি অক্সিমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডার, বিকল্প কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। এ যুদ্ধটা এতোদিন অন্যের ঘরে দেখেছি, এবার যে নিজের ঘরেই। এতোদিন মানুষকে সাহস দিয়েছি, সেই টোলারবাগের মৃত মোজাম্মল সাহেবকে এলাকার লোকজনের প্রতিবাদের মূখে গোপনে রাত ৪ টায় দাফন থেকে শুরু করে কত রোগীর সামাজিক প্রতিবন্দ্ধকতা দূরীকরণ, প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান, নিজের সহযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি সবকিছুই মনে পড়ছিল আর ভাবছিলাম কখন যে নিজেকে এ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।


ভয়কে গোপন রেখে বাচ্চাদের মনোবল যাতে না ভাঙ্গে তার জন্য কত কিছুইনা করেছি! অফিস , বাসা সামলানো সব। বাবাদের ব্যস্ততার কারনে ছেলে-মেয়েদের সাথে মায়েদের মতো একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ কম হয় অথবা গৃহস্থালি কাজে বাবাদের অংশগ্রহনটা কমই থাকে, এই দুর্যোগে ঘরের কর্ত্রীর অবর্তমানে ছেলে-মেয়েদর ঘর সামলে নেয়ার যে তাগিদ দেখলাম তা সত্যিই অভূতপুর্ব। কৃতজ্ঞতা আমার সাথে থাকা মানুষগুলোর প্রতি। করোনাকালে অনেকের ক্ষেত্রে দেখেছি আপনজনেরাও কিভাবে ছেড়ে চলে যায়, কিন্ত আমার সাথে থাকা কং মিনহায, কামরুল, মান্নান, সজল, জিলনদের দেখেছি কত আপন করে সেবা দিয়ে যেতে। তাদের সেবা দেখে মনে হচ্ছিল আমি যাতে অসহায় বোধ না করি তার কি প্রানান্তর চেষ্টা! সহকর্মী সকলে যে যে ভাবে পারছে সহযোগিতা করেছে। কমিশনার স্যার এর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় স্যার নিয়মিত খোঁজ নিয়েছন। আমার আত্মীয় স্বজন মধ্যে আমার বাসার কাছে থাকেন এক কাজিন ছাড়া কাউকেই জানাইনি। ওনি নিজে নানাবিধ শারিরীক জটিলতায় থাকায় বারবার বাসায় না আসার জন্য বললেও ঈদের দিনে অনেককিছু করেছেন। সকলের এ সাপোর্টটুকু না পেলে হয়তো এই সময়টুকু মনোবল ধরে রাখা কষ্টই হতো। কৃতজ্ঞতা সকলের প্রতি। আজ সবার পূনঃ পরীক্ষা হলো , নেগেটিভ রিপোর্ট পেলাম। যুদ্ধটা রোগের পাশাপাশি মনের । দুটোর যেকোনটা অনুকূলে না থাকলে সবকিছু থেমে যেতে পারে। আল্লাহর কৃপায় তিনি এখনো আমাদের রক্ষা করেছেন। যাদের চরম অবস্থায় পড়তে হয়েছে তাদের অনুভূতি টুকু বোঝার যদি সবাই চেষ্টা করে স্বাস্হ্য বিধি গুলো মেনে চলি তবেই আমরা নিজেও নিরাপদ থাকবো এবং অন্যকেও নিরাপদ রাখবো।।

মোস্তাক আহমেদ
উপ-পুলিশ কমিশনার
মিরপুর বিভাগ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।