করোনার প্রভাবে দেশের অধিকাংশ খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা অব্যাহত। এ অবস্থায় প্রাণঘাতী ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। এতে স্থবিরতা প্রলম্বিত হচ্ছে। এর প্রভাবে বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে দারুণ মন্দা। অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। কমেছে বেসরকারি খাতের ঋণও। সরকারি বিনিয়োগেও মন্দা। ফলে নতুন শিল্প স্থাপনের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। এতে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি কমে গেছে। চাহিদা কম থাকায় সচল শিল্পগুলোও সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন চালু রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশ বাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, করোনার প্রভাবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সার্বিক ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। সরকারি খাতে বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি হ্রাস পেয়ছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) যেমন কমেছে, তেমনই আগের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ। শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে। শিল্প খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ও চলতি মূলধন এই দুই ধরনের ঋণপ্রবাহে মন্দা দেখা দিয়েছে। ফলে শিল্প খাতে টাকার প্রবাহ কমেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ শিল্প খাতে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের নিবন্ধন কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কবে নাগাদ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো দেশ সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি। ফলে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কাজের ক্ষেত্র সংকোচিত হওয়ায় ভোক্তার আয় কমেছে। এর প্রভাবে কমেছে পণ্যের চাহিদা, কমেছে উৎপাদন। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। শুধু চলমান বিনিয়োগ ধরে রাখার কাজ করছেন।
তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে বিনিয়োগের উন্নতি হবে না। অর্থনীতিকে এক ধরনের মন্দার মধ্য দিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে থাকতে হবে। এর মধ্যেই সম্ভাবনা দেখে নতুন কৌশল নিয়ে এগোতে হবে।
বিডার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ৭২ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ২৪৯ শিল্পের বিপরীতে ৫০ হাজার ১১৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ২১৩ শিল্পের বিপরীতে ১৩ হাজার ৯৫১ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় ১৯৩ শিল্পের বিপরীতে ১২ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা, বিদেশি ও যৌথ মালিকানাধীন ২০টি শিল্পের বিপরীতে ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ওই সময়ের স্থানীয় বিনিয়োগ ৬১ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ ৯৩ শতাংশ কমেছে। তবে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল-জুনের তুলনায় জুলাই-সেপ্টেম্বরে নিবন্ধিত শিল্পের সংখ্যা ও বিনিয়োগ প্রস্তাব বেড়েছে। করোনার কারণে এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে সব ধরনের কার্যক্রম সীমিত থাকায় বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছিল, যা জুলাই থেকে বাড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতি প্রান্তিকে গড়ে শিল্প ঋণ বেড়েছে ১৩ থেকে সাড়ে ১৭ শতাংশ হারে। গত অর্থবছরে শেষ প্রান্তিকে শিল্প ঋণ বেড়েছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
নতুন শিল্প স্থাপনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মেয়াদি ঋণ। গত দুই অর্থবছরে প্রতি প্রান্তিকে মেয়াদি ঋণ বেড়েছিল গড়ে ১৫ থেকে ২২ শতাংশ হারে। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে প্রায় ১৩ শতাংশে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তা আরও কমে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমন্টে (বিল্ড) সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। যে কারণে উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে পারছেন না। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন না বলে শিল্পের মেয়াদি ঋণ কমে গেছে। উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বাড়লে, মেয়াদি ঋণ বাড়বে। এটাই রীতি। করোনার কারণে এখন থমকে আছে। তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় ঢেউ আবার একধরনের স্থবিরতা তৈরি করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এটাও দ্রুত কেটে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলমান শিল্পগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থা সক্ষমতা অনুযায়ী কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিল্পের চলতি মূলধন ঋণপ্রবাহও কমে গেছে। গত অর্থবছরে চলতি মূলধন বেড়েছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নির্মাণ খাতে এ ঋণ বেড়েছিল ১৪ শতাংশ। তৃতীয় প্রান্তিকে বেড়েছিল ৮ শতাংশ, শেষ প্রান্তিকে বেড়েছিল মাত্র ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছে ০.৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পরিবহন খাতে ঋণ বেড়েছিল ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাড়ার পরিবর্তে কমেছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যান্য শিল্প খাতের ঋণ গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছিল ২৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে ১.৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শিল্প খাতের যে সক্ষমতা আছে সেগুলো পুরো দমে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। মোট সক্ষমতার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজে লাগানো যাচ্ছে। এ কারণে চলতি মূলধন ঋণের চাহিদা কম। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। যে কারণে ওইসব দেশের আমদানিকারকরা রফতানির কার্যাদেশ দিচ্ছেন কম।
নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বেড়েছিল প্রায় ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে ০.১ শতাংশ।
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণপ্রবাহ গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশের কার্যক্রম সীমিত থাকায় ওই সময়ে বেশি কমেছে। এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, প্রায় তিন মাস কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখনও কিছুটা স্থবিরতা রয়ে গেছে। তবে মাঠপর্যায়ে ঋণের চাহিদা বাড়ছে। ফলে ঋণ বিতরণও বাড়তে শুরু করেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রবল না হলে আরও বাড়বে ঋণপ্রবাহ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য বোঝাই কনটেইনার হ্যান্ডলিংও কমে গেছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কর্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। একই সময়ে আমদানিতে কার্গো হ্যান্ডলিং গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। শেষ প্রান্তিকে কমেছিল প্রায় ২২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বেড়েছে ০.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবরে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত অক্টোবরে বেড়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল দেড় শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে দেড় শতাংশ।
সূত্র জানায়, ঋণপ্রবাহ বাড়ার কথা, তবে না বেড়ে আগের অবস্থানেই রয়েছে। অথচ দেশের মোট জিডিপির ৮০ শতাংশই আসে বেসরকারি খাত থেকে।
এদিকে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল ১৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১০ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ নতুন করে তো আসেইনি, বরং আগের বিনিয়োগের স্থিতি থেকে ১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার তুলে নেয়া হয়েছে।
করোনার প্রভাব মোকাবেলায় আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ঋণের অর্থছাড় করায় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ বেড়েছে। তবে অন্যান্য ঋণ কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এসেছিল ৯০ কোটি ১০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ১৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ওই সময়ে ঋণ বেড়েছে ৪৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। একই সময়ে ঋণ পরিশোধের দেনাও বেড়েছে। অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বেড়েছিল ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ আসেনি। উল্টো আগের ঋণের স্থিতি থেকে কমেছে ২ কোটি ডলার। অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এসেছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ আসেনি। বরং আগের ঋণ থেকে কমেছে ১ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাণিজ্যিক ঋণ গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৪৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ আসেনি। আগের ঋণের স্থিতি থেকে কমেছে ৫৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।
Source:Jugantor