সারের কৃত্রিম সংকটে ভুগছেন দেশের অধিকাংশ জেলার কৃষক। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- দেশে সারের কোনো সংকট নেই। গুদামে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ আছে। সারাদেশে ডিলারদের কাছেও সার আছে, তবু কৃষকরা সার পাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ- ডিলাররা সার গুদামে রেখে বলছেন নেই। কৃষকরা লাইন ধরেও অনেক জায়গায় সার পাচ্ছেন না। আবার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিলে মিলছে সার। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে সার নিয়ে এমন খবরে নড়েচড়ে বসেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে- দেশে এ মুহূর্তে সারের কোনো সংকট বা ঘাটতি নেই।

এমন পরিস্থিতিতে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কাজেই সার নিয়ে কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি ও বেশি দামে বিক্রি করলে ডিলারদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে। গতকাল সোমবার বিকালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠানে এ হুশিয়ারি দেন মন্ত্রী।

এর আগে গত ২১ আগস্ট সারের কৃত্রিম সংকট নিরসনে কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন কৃষিসচিব মো. সায়েদুল ইসলাম। নির্দেশনায় তিনি বলেছেন, দেশে সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কোথাও সারের সংকট হওয়ার সুযোগ নেই। কেউ যাতে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং দাম বেশি নিতে না পারে, সে বিষয়ে তদারকি জোরদার করা হয়েছে।

এ জন্য তিনি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। ডিলাররা যেন বরাদ্দকৃত সার যথাসময়ে উত্তোলন করেন তা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মনিটরিং জোরদার করার কথাও বলেন তিনি। কোথাও অধিক মূল্যে সার বিক্রির কোনো সংবাদ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা রিপোর্ট করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ডিলারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সার্বিক বিষয়াদি নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সভাপতিত্বে উপজেলা কৃষি অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ডিলারদের নিয়ে সভা করে কৃষক, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ সবাইকে সারের পর্যাপ্ততা সম্পর্কে অবহিত করার নির্দেশ দেন কৃষি সচিব। এ ছাড়া কৃষি সচিবের পক্ষ থেকে কৃত্রিম সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।

কৃষি বিষেজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। এসব সাফল্যের পেছনে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিয়ে কম দামে কৃষকদের সার সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ করে কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং অতিদ্রুত তা কার্যকর করা কৃষকসহ দেশের মানুষকে বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন করেছে। এর মধ্যে সারের কৃত্রিম সংকটে দিশাহারা কৃষক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজেলের বাড়তি দাম। সেচ ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা দুর্দশার মধ্যে পড়বেন। এ ছাড়া ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে।

কৃষি গবেষক রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, করোনা এবং বন্যার পর কৃষক আবার নতুন করে চাষাবাদ শুরু করেছেন। ঠিক এমন সময় সারের কৃত্রিম সংকট হতাশাজনক। সামনে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি সারের প্রয়োজন হয়। আমন মৌসুম চলাকালে এবং রবি মৌসুমকে সামনে রেখে সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সারের বাজার এবং সরবরাহ দেখার জন্য জেলা পর্যায়ে সারের যে কমিটি রয়েছে, তারা যদি ঠিকমতো কাজ করে তা হলে বাজারে সারের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সারের দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে বাজার নিয়ন্ত্রণ অধিকাংশই সরকারের হাতে থাকে। সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে।

সম্প্রতি বিভিন্ন জেলা থেকে সারের সংকটের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বগুড়ার ধুনটে চাহিদামতো সারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন কৃষকরা। নওগাঁর রানীনগরে আমনের ভরা মৌসুমে সারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খুচরা দোকান ও ডিলারের কাছে চাহিদামতো মিলছে না ইউরিয়া, পটাশ ও ডিএপি সার। কৃষকদের অভিযোগ- সিন্ডিকেট করে সারের সংকট তৈরি করার কারণে ডিলারদের কাছে চাহিদামতো সার না পেয়ে বাড়তি দামে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে ডিলারদের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। এ জেলায় বিএডিসির ডিলারদের কোনো গুদামঘর নেই। অনুমতিপত্র ভাড়া দিয়ে চালাচ্ছেন তারা। এর ফলে নিয়মানুযায়ী সার উত্তোলন করে কৃষকের কাছে বিক্রি না করায় গত এক মাস ধরে সংকট শুরু হয়েছে সেখানে। কুষ্টিয়ায় ডিলার, সাব-ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউ-ই নিয়ম মানছেন না। সরকার শুধু ইউরিয়ার দাম বাড়িয়েছে। অথচ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অন্যান্য সারের দামও কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে বিক্রি করছেন তারা।

গাইবান্ধায়ও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও পটাশসহ সব ধরনের সারে বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। পঞ্চগড়ের কৃষকরা সার সংকটে দিশাহারা। খুচরা বাজারে সার পাওয়া গেলেও অতিরিক্ত দাম হওয়ায় ডিলারের দারস্থ হচ্ছেন তারা। সেখানেও প্রত্যাশিত সার না থাকায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ ধরনের অভিযোগ আরও কয়েকটি জেলা থেকে পাওয়া গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুদ ৬ লাখ ৪৯ হাজার টন, টিএসপি ৩ লাখ ৯৪ হাজার টন, ডিএপি ৭ লাখ ৩৬ হাজার টন, এমওপি ২ লাখ ৭৩ হাজার টন। সারের বর্তমান মজুদের বিপরীতে আমন মৌসুমে (আগস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত) সারের চাহিদা হলো ইউরিয়া ৬ লাখ ১৯ হাজার টন, টিএসপি ১ লাখ ১৯ হাজার টন, ডিএপি ২ লাখ ২৫ হাজার টন, এমওপি ১ লাখ ৩৭ হাজার টন।

বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায়ও সারের বর্তমান মজুদ বেশি। বিগত বছরে এই সময়ে ইউরিয়া সারের মজুদ ছিল ৬ লাখ ০৬ হাজার টন, টিএসপি ২ লাখ ২৭ হাজার টন, ডিএপি ৫ লাখ ৫৬ হাজার টন এবং এমওপি ১ লাখ ৯৬ হাজার টন।