তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে নদীটির বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন’ নামে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক আট হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এ.এম. আমিনুল হক এই তথ্য জানিয়েছেন।
প্রকল্পটি চীনের ঋণ সহায়তায় পরিচালিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে চীন তিস্তা নদীতে কি ধরণের প্রকল্প হতে পারে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা নেয়ার জন্য জরিপ পরিচালনা করেছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মি. হক বলেন, “চাইনিজদের সাথে যেটা সেটা হচ্ছে ওরাই স্টাডি-টা করেছে নিজেদের খরচে। আমরা ইআরডিকে জানিয়েছি যে অর্থায়নের ব্যাপারে বিদেশি সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখন চাইনিজরা যদি ইআরডির সাথে যোগাযোগ করে আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে হয়তো এটা আগাবে।”
বর্তমানে পরিকল্পনাটি ইআরডির আওতায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভারত থেকে বাংলাদেশে যে ৫৪টি নদী প্রবেশ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তিস্তা। এটি ভারতের সোলামো লেক থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি চিলমারির কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং সফরের সময় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিষয়ে চীনের সহায়তা চেয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট।
সেই সফরে চীন আশ্বাস দেয় যে তারা জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক কেন্দ্র এবং তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন করবে দেশটি।
এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ.কে.এম. এনামুল হক শামীম বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ২১টি প্রস্তাব দাতা দেশগুলোর সাথে তুলে ধরে। এরমধ্যে তিস্তার এই প্রকল্পটির প্রস্তাবনাও ছিল।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানান, ছয় মাস আগে এ ধরণের কয়েকটি প্রকল্প দাতা দেশগুলোর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে তিস্তার প্রকল্পটির বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল চীন।
এখন অর্থায়নের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ধারণ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ – ইআরডি।
তিনি বলেন, “আমরা প্রকল্প দিয়েছি, চীন আগ্রহ দেখিয়েছে, তারা ইআরডির সাথে যোগাযোগ করবে এবং ইআরডিও তাদের সাথে যোগাযোগ করবে। এটা এখন ইআরডি-তে আছে।”
তবে ইআরডি বলছে যে প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে এখনো চীনের সাথে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়নি। তারা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছে মাত্র।
এ বিষয় ইআরডি-এর অতিরিক্ত সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আমরা সবেমাত্র পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে একটি প্রস্তাবনা পেয়েছি। এটা প্রস্তুত হতে আরো অনেক সময় লাগবে।”
“আমরা আসলে প্রাথমিক পর্যায়েও যেতে পারিনি এখনো। এটা নিয়ে আলোচনা করবো চীনের সাথে, সেটাও করি নাই এখনো।”
কী থাকবে তিস্তা বিষয়ক প্রকল্পটিতে?
ধারণা করা হচ্ছে যে, এই প্রকল্পটিতে তিস্তার উপকূল ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নানা অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রীষ্মকালে পানি সংকট দূর করতে বিভিন্ন ধরণের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেহেতু তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব রয়েছে সেটি কাটিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক বলেন, প্রকল্পটিতে এখনো পর্যন্ত যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
এগুলো হচ্ছে নদীগর্ভে ড্রেজিং করা, রিভেটমেন্ট বা পাড় সংস্কার ও বাধানো এবং ভূমি পুনরুদ্ধার।
এছাড়া বন্যা বাঁধ মেরামতেরও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বলেন, তিস্তা রেস্টোরেশন প্রকল্পে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাড় বাধানো ও সংস্কার, নদীর বিস্তৃতি একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাপে আনা এবং ভূমি পুনরুদ্ধার।
“তিস্তার বিস্তৃতি কোন এলাকায় হয়তো পাঁচ কিলোমিটার, কোথাও দেড় কিলোমিটার বা কোথাও তিন কিলোমিটার আছে। সেক্ষেত্রে এই বিস্তৃতি কমিয়ে দেড় বা দুই কিলোমিটার কিংবা প্রকল্পের নকশায় যা আছে সে অনুযায়ী করা হবে।”
তিনি বলেন, এর ফলে তিস্তার পারে থাকা শত শত একর জমি বা ভূমি পুনরুদ্ধার হবে যা ভূমিহীন মানুষ কিংবা শিল্পায়নের কাজে লাগানো হবে।
সেই সাথে ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, গভীরতা বাড়িয়ে এবং বিস্তৃতি কমিয়ে যদি একই পরিমাণ পানির প্রবাহ ঠিক রাখা যায় তাহলে নদীর পাড়ের জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এছাড়া তিস্তা নদীতে যাতে ভাঙন রোধ করা যায় সে বিষয়েও পরিকল্পনা রয়েছে।
তিস্তা চুক্তির অবস্থা কী
গত ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার মুখে তা আটকে যায়।
এরপর ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি আশ্বস্ত করেন যে তিস্তার পান ভাগাভাগি নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো হবে।
কিন্তু এর পর পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও তিস্তা সমস্যার কোন সমাধান এখনো হয়নি।
সবশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মীমাংসা আসার সম্ভাবনা থাকলেও সেটি হয়নি।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া এবং দ্বিপাক্ষিক কিছু ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরণের হতাশা রয়েছে।
এমন অবস্থায় তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারতের আশায় বসে না থেকে বাংলাদেশ নিজ থেকে উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ.কে.এম. এনামুল হক শামীম বলেন, এই পরিকল্পনাটি এখনো খুবই প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। এটি নিয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি।
এদিকে প্রকল্পটির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, চীনই আসলে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ থেকেই তিস্তা প্রকল্পের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি চীনের সহায়তায় হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পের অর্থায়নের এক বিলিয়ন ডলার কিন্তু বাংলাদেশকে সহায়তা হিসেবে নয় বরং ঋণ হিসেবে দেয়ার কথা রয়েছে। যা বাণিজ্যিক সুদের হার মিলিয়ে ফেরত দিতে হবে।
এই অর্থ ফেরত দিতে না পারলে কি ধরণের পরিণতি হতে পারে সে বিষয়টিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন রুকসানা কিবরিয়া।
তবে চীনের এই সহায়তার বিষয়টি ভারত খুব ভালভাবে নেবে না বলেও মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক।