ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড হরমুজ প্রণালীতে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি তেলবাহী জাহাজ আটক করার ঘটনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
জাহাজটিকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার দাবি জানিয়েছে দ. কোরিয়া কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, এ নিয়ে কথা বলতে হরমুজ প্রণালীতে মোতায়েন দক্ষিণ কোরিয়ার সেনা সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল ইরানে গেছে।
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বলছে তারা বিশজন ক্রুসহ হানকুক চেমি নামের জাহাজটিকে, পরিবেশ আইন লংঘন করার অভিযোগে সোমবার ওমান উপকূলের কাছ থেকে আটক করে। তারা বলছে, জাহাজটির “রাসায়নিক পারস্য উপসাগরের পানি দূষিত করছিল”।
তবে দক্ষিণ কোরিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জাহাজটি ইরানের বন্দর শহর বান্দার আব্বাসে আটক রাখা হয়েছে। হানকুক চেমি জাহাজের আটক বিশজন ক্রু দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ভিয়েতনামের নাগরিক।
ইতোমধ্যে, দক্ষিণ কোরিয়ার জল-দস্যু মোকাবেলা ইউনিটের সদস্যদের নিয়ে চই ইয়ং নামে একটি ডেস্ট্রয়ার রণতরী হরমুজ প্রণালীর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। হরমুজ প্রণালীর এই এলাকা সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি এলাকা।
দক্ষিণ কোরিয়া বলেছে তারা কোন সামরিক তৎপরতায় যেতে চায় না। তারা বিষয়টি দ্বিপাক্ষিকভাবে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানে আগ্রহী বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র চোই ইয়াং-সাম।
কোরিয়ায় জব্দ ইরানের সম্পদ
ইরানের ওপর আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাংকে ইরানের ৭০০ কোটি ডলার আটকে থাকার বিষয়টি নিয়ে ইরানে যখন একটা উত্তেজনা বিরাজ করছে, তার মধ্যেই এই জাহাজ আটকের ঘটনা ঘটল।
দক্ষিণ কোরিয়ার উপ পররাষ্ট্র মন্ত্রী চোই জং-কুন আগে থেকেই নির্ধারিত এক সফরে আগামী সপ্তাহে ইরানে যাচ্ছেন বলেও ওই মুখপাত্র জানান।
ইরান তাদের জব্দ করা অর্থসম্পদ ছাড়ানোর ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়া কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিতে এই জাহাজ আটক করেছে এমন আঁচ অনুমান নাকচ করে দিয়েছেন দ. কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী কাং কিউং-হোয়া।
“আমাদের আগে সব তথ্য যাচাই করে দেখতে হবে এবং আমাদের জাহাজের নাবিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে,” তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন। “জাহাজটির দ্রুত মুক্তির জন্য আমরা কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছি।”
দক্ষিণ কোরিয়ার রণতরী কাছাকাছি
মঙ্গলবার দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল জলদস্যু মোকাবেলা ইউনিটের সদস্যদের নিয়ে তাদের যে ডেস্ট্রয়ার জাহাজটি হরমুজ প্রণালীর কাছে পৌঁছেছে, তার লক্ষ্য দক্ষিণ কোরীয় নাগরিকদের “নিরাপত্তা নিশ্চিত করা”।
ডেস্ট্রয়ারটি যে সরু সমুদ্র পথে রয়েছে তার খুবই কাছে তেলবাহী জাহাজটি আটক করা হয়েছে। এটি উপসাগরীয় এলাকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের সমুদ্র পথ।
ইয়নহ্যাপ সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী গাল্ফ অফ এডেন এবং হরমুজ প্রণালীতে জলদস্যুদের হামলা প্রতিহত করতে গত বছর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার এই ডেস্ট্রয়ার রণতরীটি সোমালিয়া উপকূলের কাছে অবস্থান করছিল।
এক বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে এটিই ইরানের প্রথম একটি বড় জাহাজ আটক করার ঘটনা।
পণবন্দী?
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র একটি বিবৃতিতে বলেছেন তেলবাহী জাহাজটি আটক করা হয়েছে “পুরো কারিগরি ইস্যুর কারণে এবং যেহেতু সেটি সাগরে দূষণ ঘটাচ্ছিল।”
জাহাজ কোম্পানি জানিয়েছে সাগর দূষণের অভিযোগ অসত্য। জাহাজ কোম্পানির মালিককে উদ্ধৃত করে সংবাদ মাধ্যম খবর দিচ্ছে যে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্যরা হঠাৎ করে জাহাজে উঠে পড়ে এবং জাহাজের গতিপথ বদলে সেটিকে ইরানে নিয়ে যেতে বাধ্য করে।
ইরান দক্ষিণ কোরিয়া থেকে তাদের অর্থ তহবিল উদ্ধারের জন্য জাহাজটি এক অর্থে “পণবন্দী” করেছে এমন প্রস্তাব ইরান সরকার নাকচ করে দিয়েছে।
“এধরনের অভিযোগ শুনে আমরা অভ্যস্ত…পণ বন্দীর প্রশ্ন যদি তোলাই হয়, তাহলে কোরিয়ার সরকারই সেটা করেছে। তারা যে ৭০০ কোটি ডলার অর্থ আটকে রেখেছে সেটা আমাদের অর্থ,” এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের একথা বলেছেন আলি রাবিয়েই।
হরমুজ প্রণালী
ছোট হলেও হরমুজ প্রণালী পৃথিবীর অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি জাহাজ চলাচল পথ।
এই প্রণালী যে অংশে সবচেয়ে সরু সেখানে এটি আয়তনে ৯৬ মাইল দীর্ঘ এবং মাত্র ২১ মাইল চওড়া। সেখানে মাত্র দুই মাইল চওড়া এলাকা দিয়ে উভয় দিকে মাত্র দুটি জাহাজ চলাচল করতে পারে।
এই প্রণালীর উত্তর দিকে আছে ইরান, দক্ষিণে ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং এই প্রণালী গাল্ফ উপসাগরকে আরব সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে।
এই প্রণালী খুবই গভীর এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেলের ট্যাংকারগুলো চলাচলের জন্য খুবই উপযুক্ত।
পৃথিবীতে তেলের এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ প্রতিদিন ২১ মিলিয়ন ব্যারেল পরিমাণ তেল গত বছর এই হরমুজ প্রণালী দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি তেল চলাচলের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত সমুদ্র পথ।
উপসাগরীয় এলাকার প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য এই প্রণালী খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেসব দেশের অর্থনীতি তেল ও গ্যাস উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। ইরান তার তেল রপ্তানির জন্য এই সমুদ্রপথের ওপর খুবই নির্ভরশীল।
কাতারও এই সমুদ্রপথে তার উৎপাদিত তরল প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে।
তবে এশিয়ার বড় অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এই হরমুজ প্রণালীর ব্যবহার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এই হরমুজ প্রণালী দিয়ে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি হয়েছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতে। আমেরিকাও এই পথে প্রতিদিন প্রায় ১.৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করেছে।
জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী এই প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশ দিয়ে জাহাজ চলাচলের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে যে দুটি দেশের ওপর, তারা হল ইরান এবং ওমান।