অনলাইন ডেস্ক :
বাংলাদেশে এখন অনেকেই বলাবলি করছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ সংকটের সুযোগ নিয়ে কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছেন। কিন্তু একই সাথে এই প্রশ্নও ওঠে যে, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেবে, সংকট তৈরি হবে – ইত্যাদি ইস্যুগুলোতো আগেই জানা ছিল, তাহলে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আসন্ন সংকট মোকাবেলা করা গেল না কেন? এর পেছনে দায় কার? ব্যবসায়ীদের দায়ই বা কতটা?
এই প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে গিয়েছিলাম পেঁয়াজ বাজারে।
জোগানের সাথে চাহিদার সমন্বয়:
সাদিয়া রহমান প্রতিমাসে বাজার থেকে পেঁয়াজ কেনেন গড়ে প্রায় দশ কেজি।
পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় এবার তিনি ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেই ক্ষান্ত দিয়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনতে তার লাগতো ৩শ টাকা। এবার ব্যয় হয়েছে ৭শ ৫০ টাকা।
সাদিয়া রহমান বলছেন, বাড়তি টাকা ব্যয় করা তার পক্ষে সম্ভব না। তাই তিনি এখন পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘হঠাৎ করে তো রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার কমানো যায় না। কারণ, দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাস থাকে। কিন্তু এখন উপায় নেই। এতো দাম দিয়ে পেঁয়াজ কিনবো কতদিন?’
বাজার ঘুরেও ক্রেতাদের মধ্যে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ আধা কেজি পেঁয়াজও কিনছেন।
মাঝখানেতো সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন খবরও চাউর হয়েছিল যে, কোন কোন দোকানে হালি দরে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম নিয়ে কী চলছে, তা বোঝানোর জন্য সম্ভবত ভইরাল হওয়া এই একটি খবরই যথেষ্ট।
পেঁয়াজের এমন মূল্য বৃদ্ধি কি স্বাভাবিক?
ভারত রফতানি বন্ধ করায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে এমন বক্তব্যই এখন সবখানে শোনা যায়। কিন্তু সেটা যে কেজি প্রতি ১৩০ কিংবা ১৫০ টাকায় উঠে যাওয়া স্বাভাবিক নয়, এমন বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে।
মূলতঃ ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার সুযোগ যে ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন, এমন কথা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোদ ব্যবসায়ীদেরই কেউ কেউ বলছেন।
পেঁয়াজের দাম এতো বেশি কেন এমন প্রশ্নে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে একজন বিক্রেতা বলছেন, পাইকারি বাজারে যে দামে তারা পেঁয়াজ কেনেন, তার সঙ্গে বাড়তি কয়েক টাকা মুনাফা ধরে বিক্রি করা হয়।
তিনি বলছেন, ‘দাম খুচরা পর্যায়ে বাড়তেছে না। দাম বাড়তেছে পাইকারি বাজারে, আড়তে।’
তবে ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা আবার বলছেন ভিন্ন কথা।
তারা জানাচ্ছেন, শ্যামবাজারে এবার কখনোই পেঁয়াজের দাম ১১৫ টাকা ছাড়ায়নি। অথচ খুচরা বাজারে ১২০/১২৫ টাকার পরিবর্তে পেঁয়াজের দাম ছাড়িয়ে যায় ১৫০ টাকা।
‘পেঁয়াজ আটকায়া রাখো‘
শ্যামবাজারের একজন আড়তদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারত যখন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়, সেদিনই আমদানিকারকরা ফোন করে পরদিন থেকে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের।
অথচ মজুদ থাকা এসব পেঁয়াজ কম দামে আগেই কেনা হয়েছিলো।
ওই ব্যবসায়ী বলছিলেন, ‘এমনকি পরদিন ফোন করে কেউ কেউ এমনও বলছে যে, পেঁয়াজ আটকায়া রাখো। এখন ছাইড়ো না। তো বাজারে দাম বাড়ার পিছনে এইসব কারসাজি তো হইছে।’
এ বিষয়ে আমি কথা বলি শ্যামবাজারের মেসার্স আমানত ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারি জি এস মানিকের সঙ্গে।
তিনি অবশ্য বলছেন, অতীতে বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীরা ব্যাপক লোকসানের মধ্যে পড়ায় এবার হয়তো কেউ কেউ দাম বাড়িয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন।
তার ভাষায়, ‘এটাই বাজারের নিয়ম।’
সরকার কী করছে?
পেঁয়াজের আমদানি বন্ধের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যে দাম আরো বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বলছে সেকথা।
কিন্তু এর প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
বাণিজ্য সচিব মো জাফর উদ্দীন বলছেন, তারা শুরু থেকেই বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন।
‘আমরা কিন্তু বসে নেই। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় দুই হাজার ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছি। তারা কত দামে আমদানী করেছিলেন, পরিবহন খরচ কত এবং কত দামে বিক্রি করেছেন, সেসবের কাগজ তারা দেখাতে পারেননি। কেউ কেউ দাম বাড়িয়েছেন।’
বিকল্প বাজার আগেই কেন খোঁজা হয়নি?
ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছিলো গত ২৯শে সেপ্টেম্বর। কিন্তু এরও আগে ১৩ই সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানির ন্যূনতম মূল্য ৪শ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার করে ভারত।
মূলতঃ তখন থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি পড়বে এবং দামও বাড়তে পারে।
তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে পেঁয়াজের সরবরাহ এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ?
এমন প্রশ্নে বাণিজ্য সচিব অবশ্য বলছেন, রফতানি যে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা কারো ধারণায় ছিলো না। তবে এরপরই চেষ্টা করা হয়েছে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে।
‘আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বলেছি, অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে, নতুন এলসি খুলতে। মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ আসছে। কিন্তু বড় চালান মিশর থেকে বা তুরস্ক থেকে আসার কথা। সেটা আসতে সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে। আসলে সবকিছু সম্পন্ন হতে তো একটু সময় লাগবে।’
বাণিজ্য সচিব আশ্বাস দিচ্ছেন নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ স্থিতিশীল হয়ে আসবে পেঁয়াজের বাজার।
কারণ এর মধ্যেই পেঁয়াজের চালান দেশে আসবে, দেশি পেঁয়াজও উঠতে শুরু করবে।
কিন্তু মনে করা হচ্ছে, পেঁয়াজের দাম আসলে কখন, কতটা কমবে তা নির্ভর করছে ব্যবসায়ীদের উপরও।
বাংলাপোস্ট২৪/ জামিল
বাংলাদেশ সময় ১৪৫৫ নভেম্বর ০৫,২০১৯
সূত্র :বিবিসি