অনলাইন ডেস্ক :
জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেলে শাহতা জারাব এরিককে ঘিরে এরশাদের তালাক দেওয়া স্ত্রী বিদিশা বনাম জাতীয় পার্টির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক নাটকীয় রাজনৈতিক বিতর্ক। এরশাদের বারিধারার ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’ বাসভবনে বিদিশা ১৪ নভেম্বর থেকে অবস্থান করছেন। বিদিশা বলছেন, তিনি ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য নয়, ছেলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছেলের জন্য এখানে অবস্থান করছেন। আর জাতীয় পার্টি ও এরশাদ ট্রাস্টের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, এরিকের দেখভালের দায়িত্ব ট্রাস্টের। প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশা অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এদিকে এরিক তার মাকে সঙ্গে রাখার জন্য থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও চিঠি পাঠিয়েছেন এরিক। ট্রাস্টের পক্ষ থেকেও প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশার অবস্থানকে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এই ইস্যুতে বিদিশা ও ট্রাস্টের চেয়ারম্যান পৃথক সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন।
প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশাকে রাখতে এরিকের জিডি : নিরাপত্তা ও দেখভালের জন্য মা বিদিশাকে সঙ্গে রাখতে এরিক ১৮ নভেম্বর গুলশান থানায় জিডি করেন। জিডিতে উল্লেখ করেন, আমি প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ। বাবার মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান ও বাবার ছোট ভাই জি এম কাদের এবং তার অনুগতরা বিভিন্নভাবে আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে আসছে। এ কারণে গত ১৪ নভেম্বর আমি মাকে প্রেসিডেন্ট পার্কে নিয়ে আসি। আমি যাতে মাকে নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারি, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অনুরোধ জানাচ্ছি।বিদিশার অবস্থান অবৈধ বলে ট্রাস্টের জিডি : প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশার অবস্থানকে অবৈধ উল্লেখ করে গুলশান থানায় ২৩ নভেম্বর সাধারণ ডায়েরি করেছেন ট্রাস্টের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মো. খালেদ আখতার। জিডিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। প্রয়াত এরশাদের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ট্রাস্টের অধীনে। যা এরিকের ভরণ পোষণ ও জনকল্যাণে গঠিত হয়েছে। এরশাদের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট পার্ক যথারীতি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ট্রাস্টের ওই বাসায় গত ১৪ নভেম্বর প্রয়াত এরশাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধভাবে প্রবেশ করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপির সম্পর্কে মানহানিকর বক্তব্য দিয়ে আসছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এরিক এরশাদকে প্রভাবিত করে তাকে দিয়েও অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য প্রচার করে আসছেন। জি এম কাদের তার ভাইয়ের (এরশাদ) জীবদ্দশায় তার মৌখিক নির্দেশে এরিক এরশাদের সার্বিক তত্ত্বাবধান করে আসছিলেন। ট্রাস্ট গঠিত হওয়ার পর এরিক এরশাদের দেখাশোনার দায়িত্বভার ট্রাস্টের ওপর অর্পিত হলে বোর্ড অব ট্রাস্টিরা দেখাশোনা করে আসছেন।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে এরিকের চিঠি : মা বিদিশার সঙ্গে থাকতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে ২২ নভেম্বর চিঠি লিখেছেন এরিক এরশাদ। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতিকে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলেন, আমার বাবা এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে আমার চাচা জি এম কাদের ও তার অনুগতরা বিভিন্নভাবে আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছে। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে তারা কৌশলে আমার বাবার লাশ পর্যন্ত আমাকে দেখতে দেয়নি। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অপবাদ দিয়ে মা-ছেলের সম্পর্ককে ছিন্ন করেছিলেন। কখনো কখনো আমাকে রাখা হতো অনাহারে, অর্ধাহারে। এমনকি আমার বাড়িতে কর্মরত ড্রাইভার ও কাজের বুয়া দিয়ে আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হতো।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে চিঠিতে এরিক লিখেছেন, আমি একজন অসহায় পিতৃহারা শারীরিক প্রতিবন্ধী বালক। আমি অন্যের সহযোগিতা ছাড়া ঠিকমতো চলতেও পারি না। আমি যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক, আমার স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। তাই আমার মাকে নিয়ে নিজ বাড়িতে সুন্দরভাবে বসবাস করতে চাই। আপনি আমাদেরকে আমার অর্থ ও সম্পদ লোভী চাচার হাত থেকে রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
ট্রাস্টের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন : এরিক এরশাদকে নিয়ে বিদিশা নাটক করছেন বলে অভিযোগ করেছেন এরশাদ ট্রাস্টের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খালেদ আখতার। তিনি বিদিশাকে অনুপ্রবেশকারী উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। শনিবার বনানী অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদ আখতার এসব অভিযোগ করেন। খালেদ আখতার বলেন, বিদিশা সিদ্দিকী যা বলছেন, সব অসত্য। প্রেসিডেন্ট পার্কের বাড়িটি ট্রাস্টের সম্পদ, এখানে এরিকের সঙ্গে বিদিশার থাকার কোনো এখতিয়ার নেই। ১৪ নভেম্বর অবৈধভাবে প্রেসিডেন্ট পার্কে অনুপ্রবেশ করেছে। আমরা ট্রাস্টের সদস্যরা এতে উদ্বিগ্ন। এতে এরিকের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পার্কে অবৈধভাবে প্রবেশ করার পর থেকে বিদিশা এরিককে নিয়ে নাটক করছেন। এরিককে দিয়ে শেখানো বুলি বলানো হচ্ছে। বিদিশার কাছ থেকে এরিককে আলাদা করে কথা বলেন, দেখবেন সব উল্টে যাবে। এরিককে ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব বলানো হচ্ছে। আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব। মেজর (অব.) খালেদ দাবি করেন, এরিকের সেবা-যতেœ কোনো রকম কমতি নেই। যারা বাসায় তার দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে, তাদের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছে এরিক। এরিকের প্রতি তাদের মমত্ববোধের কোনো ঘাটতি নেই। জি এম কাদের অভিভাবক হিসেবে ছেলের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে এরিককে লালনপালন করছেন। জি এম কাদের ট্রাস্টের সদস্যও নন এখানে তার লোভলালসার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
বিদিশার সংবাদ সম্মেলন : এর আগে শুক্রবার গণমাধ্যম কর্মীদের বিদিশা বলেন, ঠিকানা বদল করার জন্য এখানে আসিনি। আমি আমার সন্তানকে চাই। মা হিসেবে শুধু আমি আমার সন্তানকেই চাই। যতদিন ওর বাবা বেঁচে ছিলেন তখন আমার চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর অন্যরা আমার সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতে দেয়নি। ওর চাচা স্পেশালি। জি এম কাদের সাহেব মানা করে দিয়েছেন এরিক যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে। তারা আমার বাচ্চার যত্ন নেয়নি। আমার সন্তানের অধিকার আমি ছাড়ব না। এ সময় এরিক বলেন, অভিযোগ করা হয়েছে মা এখানে সশস্ত্র অবস্থায় এসেছেন। কিন্তু এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
জি এম কাদেরের বক্তব্য : এরিক একজন ‘স্পেশাল চাইল্ড’। আমার মনে হয় না, সে নিজে থেকে এসব করছে। কেউ হয়তো তাকে দিয়ে করাচ্ছে। তিনি বলেন, ভাই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর যেন বাবার দায়িত্ব পালন করি। তিনি বলেন, আমি ট্রাস্টের সদস্য না। ট্রাস্টের সম্পদ নিয়ে আমাকে ঘিরে যেসব কথা বলা হচ্ছে তার কোনো অর্থই নেই।