মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিনের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন মাহাথির মোহাম্মদ। সুযোগ বুঝে ইয়াসিনের কানে চিমটিও কেটেছেন। মাহাথির বুঝিয়ে দিয়েছেন যে বয়স ৯৫ বছর হলেও এখনো রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দেননি তিনি। আবার ক্ষমতার বলয়ে ফেরার জন্য তিনি কসরতও করছেন জোরেশোরে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তাতে পাকাতান হারাপান জোটের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। ওই সময় মাহাথিরের নিজ দল বেরসাতুতেও ভাঙন ধরে। বের হয়ে যান মুহিদ্দিন ইয়াসিন। তিনি নতুন জোট গঠন করেন ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) সঙ্গে। এই ইউএমএনও এখন মূলত দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের রাজনৈতিক দল।ওই সময় মাহাথিরের পদত্যাগের মূল কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়া আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ। আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, মাহাথির সেই মোতাবেক কথাও দিয়েছিলেন ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে। কিন্তু দুই বছর পর আর আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাননি তিনি। আর তাতেই পাকাতান হারাপান জোটে ভাঙন ধরে। ওই সুযোগে মাহাথিরের নিজের রাজনৈতিক দলের মুহিদ্দিন ইয়াসিন দল ভেঙে বনে যান প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে অবশ্য দেশটির সুলতানের আনুকূল্যও পেয়েছেন ইয়াসিন।
মাহাথির অবশ্য ভেঙে গেলেও মচকাননি। তিনি পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে চেয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন ইয়াসিনের প্রতি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সুকৌশলে তা এড়িয়ে গিয়ে এবং করোনাভাইরাস মহামারির দোহাই দিয়ে পার্লামেন্ট বন্ধ রাখেন প্রায় পাঁচ মাস। নিন্দুকেরা বলে থাকেন, ঠিক ওই মুহূর্তে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করা ইয়াসিনের জন্য কঠিন ছিল। তাই এই সময়ক্ষেপণের কৌশল। অবশেষে ১৩ জুলাই পার্লামেন্টে স্পিকার পরিবর্তনের প্রস্তাব আনেন ইয়াসিন।
হ্যাঁ, এই প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে জিতেছেন মুহিদ্দিন ইয়াসিন। তবে সেই জয় হয়েছে মাত্র দুই ভোটের! ২২২ জন আইনপ্রণেতার মধ্যে ১১১ জন ইয়াসিনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিরোধী পক্ষে ছিলেন ১০৯ জন। বাকি দুজনের একজন ছিলেন অনুপস্থিত। আরেকজন স্পিকার পরিবর্তনের সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন বলে ভোট দিতে পারেননি। এবার বুঝে দেখুন, ফেব্রুয়ারি বা মার্চে পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হলে কী হতো?
এবার বুঝে দেখুন, ফেব্রুয়ারি বা মার্চে পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হলে কী হতো?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুলতানের আনুকূল্যে এত দিন পার্লামেন্ট বন্ধ রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। মূল উদ্দেশ্যই ছিল নিজের দল ভারী করা। কিন্তু ১৩ জুলাইয়ের ভোটাভুটিতে এটি স্পষ্ট যে সেই কাজ ঠিকমতো হয়নি। ফলে ইয়াসিনের সরকার এখন খাদের কিনারায় চলে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে পতন ঘটার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, নিজেদের দল বেশি ভারী করতে না পারায় পার্লামেন্ট খুলেই স্পিকার পরিবর্তন করতে চেয়েছেন ইয়াসিন। যাতে মাহাথির অনাস্থা প্রস্তাব আনলেও তা ঠেকানো যায়। এ কারণেই নিরপেক্ষ স্পিকার বদলে সেখানে বিশ্বস্ত লোক বসানো হয়েছে। এর ফলে অনাস্থা প্রস্তাব এলে তা খারিজ করা যাবে স্পিকারের মাধ্যমে।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক জেমস চিন বলছেন, ভোটাভুটির ফলাফলে এটি পরিষ্কার যে দুই পক্ষই সংখ্যাগত দিক থেকে অত্যন্ত কাছাকাছি। ফলে মুহিদ্দিন ইয়াসিনের সরকার স্থিতিশীল থাকবে না। পতনের আশঙ্কা থাকছেই।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে মুহিদ্দিন ইয়াসিন এক বিশাল মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। ইয়াসিনের ৭০ সদস্যের মন্ত্রিসভাই এযাবৎকালে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় মন্ত্রিসভার তকমা পেয়েছে। অর্থাৎ ১১১ জন স্বপক্ষের আইনপ্রণেতার ৭০ জনই মন্ত্রী! আর বাকিরা পেয়েছেন সরকারি বিভিন্ন কোম্পানিতে চেয়ারম্যান বা পরিচালকের পদ। অথচ করোনাভাইরাস মহামারিতে তেমন আহামরি কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি মালয়েশিয়ার সরকার। উল্টো এসেছে অভিবাসী কর্মীদের প্রতি নিদারুণ অবিচারের অভিযোগ।
ওদিকে নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ বলছে, রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে। দেশটিতে স্থানীয় মুদ্রায় সুদের হার রেকর্ড হারে কমে গেছে। ২০০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও সুদের হার এত কমেনি। এর ওপর আছে করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত অর্থনৈতিক স্থবিরতা। দেশটি থেকে মোট রপ্তানির পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে না মুহিদ্দিন ইয়াসিনের সরকার। ফলে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন গভীর হচ্ছে।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই আবার আওয়াজ তুলেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। এশিয়া টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইয়াসিনের সরকার একটি অবৈধ সরকার। এটি নাজিব রাজাকের মতো দুর্নীতবাজদের ক্লিনচিট দিতে উঠে–পড়ে লেগেছে। কারণ, নাজিবের ইউএমএনও দলের সমর্থন ছাড়া এক দিনও টিকবে না বর্তমান সরকার। তাই টিকে থাকতে হলে নাজিবকে সুরক্ষা দিতে হবে ইয়াসিনকে।
মাহাথিরের অভিযোগ, সরকার–নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। দুর্নীতি কমাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এখন ইয়াসিন ক্ষমতায় এসে সব পেশাদারকে সরিয়ে সেখানে রাজনীতিকদের বসাচ্ছেন। ফলে দুর্নীতির পথ সুগম হচ্ছে।
সিএনবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে মাহাথির মরিয়া। শুরুতে ফের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিরোধী জোট পাকাতান হারাপানে এখন আনোয়ার ইব্রাহিমের খুঁটি শক্ত। তাই মাহাথিরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব হালে পানি পায়নি। তবে হাল ছাড়েননি মাহাথির, নিয়ে এসেছেন নতুন পরিকল্পনা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেহেতু মুহিদ্দিন ইয়াসিন পার্লামেন্টে নতুন স্পিকার বসিয়ে ফেলেছেন, তাই এখন নির্বাচনের অপেক্ষা করা ছাড়া মাহাথিরের উপায় নেই। মাহাথিরও সেটা বোঝেন। তাই নির্বাচন ও ভোট নিয়েই ভাবছেন তিনি। সম্প্রতি নিজের পরিবর্তে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাফি আপদালের নাম প্রস্তাব করেছেন তিনি। মাহাথিরের মতে, দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিমের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। তাই শাফি আপদালকেই তিনি যোগ্য নেতা বলে মনে করছেন। পূর্ব মালয়েশিয়ার সাবাহ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শাফি আপদাল। নিন্দুকেরা বলছেন, মাহাথির আসলে নিজের পছন্দের লোককে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে চাইছেন, যাতে ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি তাঁর হাতেই থাকে।
ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু পার্লামেন্টে মুহিদ্দিন ইয়াসিনের সমর্থন ততটা পোক্ত নয়, সেহেতু মধ্যবর্তী নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। মালয় মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদ নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তাভাবনাও করছেন। সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির বলেছেন, মুহিদ্দিন ইয়াসিনের কারণে তাঁর দল ভেঙে গিয়েছে। ভাঙা দল নিয়ে নির্বাচন করার পরিবর্তে তিনি নতুন নামে নতুন একটি দল আনার বিষয়ে ভাবছেন। প্রয়োজন হলে নতুন দল গঠন করতে তিনি পিছপা হবেন না বলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন।
সুতরাং, মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল হচ্ছে দিন দিন। মাহাথির মোহাম্মদ এই মাঠের পুরোনো খেলোয়াড়। চলতি মাসেই ৯৫-এ পা দিয়েছেন তিনি। নব্বইয়ের কোটাতে এসেই সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মাহাথির। বুড়ো হাড়ে তিনি যে আবার ভেলকি দেখাবেন না—কে বলতে পারে!