অনলাইন ডেস্ক :
বিশ্বব্যাপী যে দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে সেই দেশগুলোতে সংক্রমণ বৃদ্ধি ও মৃত্যুর প্রবণতার সাথে বাংলাদেশের একটি ব্যাপক পার্থক্য চোখে পড়ছে।
বুধবার দেশটিতে ষষ্ঠ ব্যক্তির মারা যাওয়ার তথ্য দিয়েছে সরকারি সংস্থা আইইডিসিআর। এ নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় নতুন তিনজন সহ দেশে মোট ৫৪ জন আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেন।
অথচ ঘনবসতি, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতার অভাব এবং সাধারণ মানুষের পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসে ঘাটতি – এসব কারণে বাংলাদেশে ভাইরাসটির ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
ভাইরাসের ভিন্ন আচরণ?
চীনের উহানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল ডিসেম্বরের শেষে। জানুয়ারির শেষের দিকে চীনের সকল প্রদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, চীনে ৮২ হাজারের বেশি রোগীই ছিল তখন সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু দ্রুতই চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশে ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করে। চীনের পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষজন বেশ আক্রান্ত হতে থাকে।
ইউরোপে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত দেশগুলোর একটি ইতালি। জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে জানুয়ারির শেষে ইতালিতে সংক্রমণ শুরুর পর ৫৯ দিনে এখনো পর্যন্ত সব মিলিয়ে এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৭ দিনে দেড় লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।
![জনসমাগম](https://ichef.bbci.co.uk/news/624/cpsprodpb/8409/production/_111510833_gettyimages-1208879550.jpg)
বিশ্বের সবচেয়ে আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলো যেমন স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য প্রায় সবগুলো দেশেই ভাইরাসটি বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিই দেখা গেছে।
বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন ইতালি ফেরত। কিন্তু সেই ইতালি থেকে আসা ভাইরাস বাংলাদেশে কী ভিন্ন আচরণ করছে? এর সম্ভাব্য কী ধরনের কারণ থাকতে পারে?
ভাইরোলজিষ্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, “বাংলাদেশের ডাটা অন্যদের সাথে মেলে না কেন সেনিয়ে আমিও চিন্তা করছি। আমাদের এখানে ভাইরাসটি ইতালি থেকে এসেছে। সেটি ইতালিতে হ্যাভক তৈরি করলো আর আমাদের এখানে কিছুই করছে না এরকম একটা ব্যাপার। বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না।”
“তবে উহান থেকে যে ভাইরাসটির উৎপত্তি তা কিন্তু মিউটেশন হয়েছে। কিছু দেশে একই ধরনের সংক্রমণের প্যাটার্ন হয়েছে। আবার অন্য কোথাও একটু ভিন্ন। আমাদের ভাইরাসটি উহান থেকে আসেনি।”
তিনি বলছেন, “দেখুন, জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে অনেক দেশে, কিন্তু একটা দেশেই, মাইক্রোকেফালি দেখা দিল। – সেটা ব্রাজিলে।”
“তারপর একটা ভাইরাস মালয়েশিয়াতে তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে নিপাহ ভাইরাস। যেটা বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের দিকে এলো এবং বাংলাদেশেই ঘোরাফেরা করছে। ভাইরাসের চরিত্র যথেষ্ট গবেষণা না করে বলা কঠিন।”
তিনি আরও বলছেন শুধু ভাইরাস নয়, যিনি ভাইরাসটি বহন করছেন তার কথাও বিবেচনা করতে হবে। সেটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, “একটা ভাইরাস আছে সেটা আফ্রিকানদের যখন আক্রান্ত করে তখন তাদের এক ধরনের ক্যান্সার হয়, একটা লিম্ফোমা হয় ।”
“আর সেই ভাইরাসটিই যখন চীনাদের ইনফেক্ট করে – তখন তাদের নেজো-ফেরেঞ্জিয়াল কার্সিনোমা হয়। যারা ইনফেকটেড হয় তাদের জীনগত বিষয়টাও দেখতে হবে। একটা দেশের মানুষজনের জীনগত বৈশিষ্ট্যের উপরেও অনেক সময় রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক থাকে।”
![ভাইরাস](https://ichef.bbci.co.uk/news/624/cpsprodpb/16A81/production/_111510829_2a6d22c4-0e3a-4618-af66-5a690d50e5f4.jpg)
পরীক্ষা নিয়ে সন্দেহ
বাংলাদেশে ভাইরাসটির যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে কিনা, সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেনিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে।
প্রচুর পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের আনার ব্যাপারে সফলতার জন্য প্রশংসিত হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া।
সংক্রমণ শুরুর পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাড়ে তিন লাখের মতো মানুষকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে গত ৮ই মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর ১৮ই মার্চ প্রথম ব্যক্তির মৃত্যু সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। পরবর্তী ২৩ দিনে দেশে মোট ১৭শ’র মতো ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হয় বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তথ্য গোপন করার অভিযোগও তুলে পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি বলছেন, “বাংলাদেশ পরিচালিত হয় গোয়েন্দাদের দ্বারা। তারা জানে কিভাবে তথ্য লুকাতে হয়। পরীক্ষার দায়িত্ব একটা এজেন্সিকে দেয়া হল। দুই হাজার কিট থাকা সত্বেও তারা দুশো’টা ব্যাবহার করতেই সময় নিয়েছে অনেক বেশি।”
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত শুধু আইইডিসিআর করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করছে। সেজন্য যে হটলাইন খোলা হয়েছে – সেখানে ফোনে পরীক্ষা সম্পর্কে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তার সমালোচনা করে তিনি বলছেন, “আমার হাসপাতালে একটা রোগী এলো যার লক্ষণ দেখে করোনাভাইরাস মনে হচ্ছিল।”
“আমি নিজে চার ঘণ্টা চেষ্টা করে যখন ফোনে পেলাম, তারা জিজ্ঞেস করলো উনি কি বিদেশ থেকে আসছে। না বলার পর তারা ফোন রেখে দিল। টেস্টই তো হচ্ছে না যথেষ্ট। “
![গাড়ি ও পুলিশ।](https://ichef.bbci.co.uk/news/624/cpsprodpb/12049/production/_111510837_gettyimages-1208872620.jpg)
তথ্যের ঘাটতি
বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে কিট নেই – এমন তথ্য দেয়া হয়েছে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে। তবে কয়েকদিন আগে চীন থেকে অনুদান হিসেবে ৩০ হাজার কিট এসেছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুব বেশির শুরুর পর সরকার বাংলাদেশে সকল বন্দরে বিদেশ ফেরতদের স্ক্রিনিং-এর কথা জানালেও সেটা নিয়েও ব্যপক অনাস্থা তৈরি হয়।
চাপের মুখে ১৬ই মার্চ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৪শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, তবে ২৬শে মার্চ গণ-পরিবহন বন্ধ হওয়ার আগেই এক সাথে ঢাকা ছাড়েন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
যদিও জনসমাগম এড়িয়ে চলাকে ভাইরাসটি প্রতিরোধের অন্যতম উপায় বলা হচ্ছে।
এতে করে নতুন আশঙ্কা তৈরি হয় করোনাভাইরাসটি আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ার।
![ঢাকায় লকডাউনের আগে করোনাভাইরাসে নিয়ে আতংক ছড়ানোর সময় থেকেই অনেকে মুখোশ পরে বাইরে বেরুচ্ছিলেন](https://ichef.bbci.co.uk/news/624/cpsprodpb/08AD/production/_111512220_gettyimages-1207931901.jpg)
তবে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সেস-এর এপিডোমোলজি বিভাগের প্রধান ড. প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত বলছেন, ভাইরাসটির প্রবণতা ভিন্ন কিনা সেনিয়ে যথেষ্ট গবেষণার আগে খুব বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তিনি আরও কিছুদিন অপেক্ষার কথা বলছেন।
তিনি বলছেন, “এটা নতুন ভাইরাস। পশ্চিমা বিশ্বেও কিন্তু খুব বেশি তথ্য নেই। কিছু হাইপোথিসিস আছে, যেমন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। কিন্তু এ সম্পর্কে কোন ভ্যালিড ডাটা নেই। তাই হাইপোথিসিসগুলোকে গ্রহণ বা নাকচ কোনটিই করতে পারছি না।”
পাশের দেশ ভারতে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। সেখানে এখনো পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে ২১ দিনের লকডাউন জারি রয়েছে। যা ঘোষণা করার পর কোটি কোটি মানুষ একসাথে শহর ছেড়েছেন। সেখানেও জনসংখ্যার অনুপাতে সংক্রমণ কম দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে শুরু থেকেই ব্যপক সতর্কতার দাবি করে আসছে সরকার।
পরীক্ষার পদ্ধতি ও যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে কিনা সেনিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে যোগাযোগ করে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বি বি সি বাংলা