ইউএই, বাহরাইন, সুদানের পর আরো একটি আরব মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজী হয়েছে।

এবং আগের তিনটি দেশের মতই – মরক্কোকেও রাজী করিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন।

সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্তের ঘোষণাও এসেছে হোয়াইট হাউজ আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইটার আ্যাকাউন্ট থেকে, তেল আবিব বা রাবাত থেকে নয়।

কিন্তু যে পুরষ্কারের লোভ দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মরক্কোকে তার তথাকথিত “আব্রাহাম চুক্তির“ অংশীদার করেছেন – তার সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিতে শুরু করেছে।

দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে ওয়েস্টার্ন আফ্রিকা নামে সাবেক স্প্যানিশ উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে বিরোধ চলছে – তাতে সরাসরি পক্ষ নিয়ে মি ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ঐ এলাকার ওপর মরক্কোর একক সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

মরক্কো অত্যন্ত খুশী। কারণ যার জন্য তারা ১৯৭৫ সাল থেকে চেষ্টা করছে, তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির স্বীকৃতি যে মরক্কোর জন্য বড় একটি কূটনৈতিক সাফল্য – তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

সংঘাতের নূতন রেসিপি

কিন্তু বাস্তবে ওয়েস্টার্ন আফ্রিকায় সার্বভৌমত্ব কায়েম করা কতটা সহজ হবে মরক্কোর জন্য?

এই এলাকায় স্বাধীন একটি দেশ গঠনের লক্ষ্যে যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী গত চার দশক ধরে সশস্ত্র আন্দোলন করছে সেই পলিসারিও ফ্রন্টের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে – তারা একে প্রতিরোধ করবে।

পলিসারিও ফ্রন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, ওয়েস্টার্ন আফ্রিকায় মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তারা বলেছে, “ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সনদের নগ্ন লঙ্ঘন।“

ইউরোপে এই সংগঠনের প্রতিনিধি ওবি বিচারিয়া রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি এই বিরোধের বাস্তবতা বদলাতে পারবেনা, ওয়েস্টার্ন সাহারার মানুষের স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষাকে এক বিন্দু টলাতে পারবে না।“

লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওয়েস্টার্ন সাহারা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন মরক্কোর জন্য একটি “কূটনৈতিক বিজয়“ সন্দেহ নেই, “কিন্তু এই বিজয়ের ফসল কীভাবে, কত সহজে তারা ঘরে তুলতে পারবে, তা অনিশ্চিত।“

মি. হামদি মনে করেন, পলিসারিও ফ্রন্টের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হবে আলজেরিয়া।

“আলজেরিয়া পলিসারিও ফ্রন্টের প্রধান সমর্থক, ওয়েস্টার্ন আফ্রিকায় তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ মরক্কোর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তির এই সিদ্ধান্তকে কীভাবে তারা চ্যালেঞ্জ করবে তা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে আলজেরিয়া – সন্দেহ নেই।“

সাদি হামদি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে হলে আলজেরিয়াকে এখন বড় কোনো শক্তিধর দেশের মুখাপেক্ষী হতে হবে। “রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতে পারে আলজেরিয়া, কারণ আরব দুনিয়ায় এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকায় তাদের সামরিক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে রাশিয়া বেশ অনেকদিন ধরেই সচেষ্ট।”

“নতুন এই বিরোধ রাশিয়ার জন্য একটা সুযোগ“ – বলেন তিনি।

“ফলে ইসরায়েল-মরক্কো চুক্তি এবং তার শর্ত উত্তর আফ্রিকায় নতুন সংঘাত এবং মেরুকরণের সূচনা করতে পারে। সংঘাত সংঘর্ষ এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে।“

আর তেমন দলাদলি মেরুকরণ শুরু হলে তাতে ইসরায়েলের বৈরী দেশ ইরানের ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

জেরুজালেমে গবেষণা সংস্থা বেগিন-সাদাত সেন্টার অফ স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষক ড রাফায়েল জি বচনিক সংস্থার অনলাইন প্রকাশনায় লিখেছেন, এমন প্রমাণ রয়েছে যে আগেও আলজেরিয়ার মাধ্যমে ইরান পলিসারিও যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে।

ড. বচনিক – যিনি একসময় ইসরায়েলি সেনা গোয়েন্দা বিভাগের বিশ্লেষক হিসাবে কাজ করতেন – লিখেছেন, পলিসারিও ফ্রন্টকে সাহায্য করার অভিযোগেই ২০১৮ সালের মে মাসে মরক্কো ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, এবং রাবাত থেকে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে।

তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, বড় কোনো বিরোধ এখনই হয়তো চোখে পড়বে না।

তিউনিসে বিবিসির উত্তর আফ্রিকা সংবাদদাতা রানা জাওয়াদ বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে ওয়েস্টার্ন আফ্রিকা নিয়ে চলতি বিরোধের মৌলিক কোনো বদল ঘটবে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ, তার মতে, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের খেয়ালিপনার চেয়ে এই সমস্যার জটিলতা অনেক গভীর।“

তবে, রানা জাওয়াদ বলেন, মি ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে কারণ এই অঞ্চলের মানুষ কয়েক দশক ধরে যে স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখছে তা অনেকটাই চোট খাবে।

সাদি হামদিও বলছেন, ইসরায়েল-মরক্কো চুক্তির প্রভাবে কী হতে পারে তা এখনও অনেকটাই অনিশ্চিত।

সাদি হামদিও বলছেন, ইসরায়েল-মরক্কো চুক্তির প্রভাবে কী হতে পারে তা এখনও অনেকটাই অনিশ্চিত।

স্পেনের মাদ্রিদে ওয়েস্টার্ন সাহারায় স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সাহরাওয়িদের বিক্ষোভ, অক্টোবর ২০২০
স্পেনের মাদ্রিদে ওয়েস্টার্ন সাহারায় স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সাহরাওয়িদের বিক্ষোভ, অক্টোবর ২০২০

“জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর কি তিনি কি তথাকথিত আব্রাহাম চুক্তি নিয়ে একই রকম আগ্রহ দেখাবেন? তিনি কি ওয়েস্টার্ন আফ্রিকায় মরক্কোর সার্বভৌমত্ব অনুমোদনের জন্য জাতিসংঘের ওপর চাপ তৈরি করবেন? লিবিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য যে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ সেই আলজেরিয়াকে তিনি কতটা চটাবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও ধোঁয়াটে।“

ওয়েস্টার্ন সাহারাবিরোধের ইতিহাস

১৯৭৫ সালে ওয়েস্টার্ন সাহারায় স্পেন তাদের ঔপনিবেশিক শাসন শেষ করার পর মরক্কো এ অঞ্চলে তাদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে।

কিন্তু বাদ সাধে অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা যারা সাহরাওয়ি নামে পরিচিত, এবং বর্তমানে যাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখের মত।

সাহরাওয়য়ি আরব ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক নামে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে শুরু হয় সশস্ত্র বিদ্রোহ – যাতে সরাসরি সমর্থন যোগায় আলজেরিয়া।

বিদ্রোহী পলিসারিও ফ্রন্টের সদর দপ্তরও আলজেরিয়ার টিনডফ শহরে। আলজেরিয়ায় এখনও প্রায় লাখখানেকের মত সাহরাওয়ি শরণার্থী রয়েছে।

প্রায় ১৫ বছর লড়াইয়ের পর ১৯৯১ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়, এবং সিদ্ধান্ত হয় যে জাতিসংঘের তত্বাবধানে একটি গণভোটের মাধ্যমে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।

কিন্তু গত ৩০ বছরেও সেই গণভোট করা সম্ভব হয়নি।

দীর্ঘদিন যুদ্ধবিরতির পর গত মাস দুয়েক ধরে নতুন করে পলিসারিও ফ্রন্ট এবং মরক্কোর সেনাবাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, যার জন্য দু পক্ষই পরস্পরকে দায়ী করছে।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নতুন করে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ হয়তো মরক্কোকে যুক্তরাষ্ট্রের কথা মেনে ইসরায়েলের সাথে চুক্তি করতে উৎসাহ জুগিয়েছে।