অনলাইন ডেস্ক:
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে এগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগও নেয়া সরকার।
সরকারের এই মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা বহুমূখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লা ভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ কতদূর এগিয়েছে?
পদ্মা সেতু :
সরকারের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পদ্মা সেতু প্রকল্প। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন পদ্মায় মূল সেতুর কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।
বিদায়ী বছরের শেষ দিন পর্যন্ত সেতুর বিশটি স্প্যান বসানো হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এই সেতুর ৪২টি পিয়ারে মোট ৪১টি স্প্যান বসবে। এই সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি আর নীচ দিয়ে ট্রেন চলার কথা রয়েছে। ব্যাপক বিতর্ক আর আলোচনায় কয়েক বছরের বিলম্বের পর ২০১৪ সালে এই সেতুর নির্মাণ কাজ নিজস্ব অর্থে সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার।
মিস্টার কাদের বলেছেন সেতুটি ২০২১ সালের জুন নাগাদ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
মেট্রো রেল:
২০২০ সালের প্রথম দিনে ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও রেল ট্র্যাক বসানোর কাজের সূচনা করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এসময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, এমআরটি লাইন ৬ যেটি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের সাড়ে আট কিলোমিটার সেটি এখন দৃশ্যমান। এটিতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ যাত্রী চলাচল শুরু করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, এ প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ১৬টি স্টেশন হবে এবং মেট্রোরেল ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ:
পদ্মা সেতু রেল সংযোগটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কথা।
২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মাওয়াতে পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে এরপর থেকে কাজ এগিয়েছে ধীর গতিতেই।
চীনের সাথে চুক্তিতে বিলম্ব, নকশা নিয়ে সমস্যা, ঠিকাদারের সাথে সময়মত চুক্তি না হওয়ায় এ প্রকল্প প্রত্যাশা মতো এগোয়নি।
তবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বিবিসি বাংলাকে বলছেন মোট ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ যশোর পর্যন্ত।
যদিও তাদের অগ্রাধিকার হলো মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত। বাকী রেলপথ করা আছে।
“পুরো প্রকল্পের জন্য আমাদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় দেয়া আছে। তবে পদ্মা সেতুর অগ্রগতির সাথে সাথে রেলের কাজও চলছে। ভাঙ্গা থেকে মাওয়া ২৬ কিলোমিটার নতুন এলাইনমেন্ট ধরে কাজ চলছে। আশা করি যেদিন পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলবে, সেদিন থেকে ট্রেনও চলবে”।
দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল:
রেলমন্ত্রী বলছেন বনের জায়গা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কারণে সরকারের এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুতে বিলম্ব হলেও ইতোমধ্যেই এর ৩০/৩৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
“এখন সমস্যা কেটে গেছে এবং কাজও পুরোদমে চলছে। আশা করি নির্ধারিত ২০২২ সালের মধ্যেই এ প্রকল্পটি আমরা সম্পন্ন করতে পারবো”।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র:
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাবনার রূপপুরে দুই হাজার চারশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার।
চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল সাত বছর ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
কর্মকর্তারা আশা করছেন নির্ধারিত সময়েই প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে।
যদিও এ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি টারবাইন হলের ভিত্তি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে গত অগাস্টেই।
এক লাখ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে পাবনার রূপপুরে, যেখানে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র:
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যাশা, সব বাধা মিটিয়ে ২০২১ সালের শেষ দিকেই রামপাল থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসতে শুরু করবে।
তবে শুরু থেকে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কারণে রামপাল প্রকল্প পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং নিকটবর্তী সুন্দরবনে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনবে – এই যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশবাদী বহু সংগঠনই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করছে।
তবে সরকার বলছে, যে ধরনের প্রযুক্তি রামপালে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে কয়লা সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি করবে না।
মোংলা-খুলনা মহাসড়কের পাশে রামপালে প্রায় ১৮৩৪ একর জমির ওপর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং এতে ব্যয় হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ:
মাতারবাড়ী ও ঢালঘাটা ইউনিয়নের এক হাজার ৪১৪ একর জমিতে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
কয়লা ভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে। কর্মকর্তারা বলছেন, এর কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে।
২০২৩ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ:
মহেশখালীর কাছে বঙ্গোপসাগরে যা ভেসে আছে, সেটির নাম হচ্ছে ‘ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট'(এফএসআরইউ)।
বিশাল এই জাহাজ-কাম-টার্মিনালটি কাতার থেকে নিয়ে এসেছিলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি। সেই তরল জ্বালানিকে আবার গ্যাসে রূপান্তরিত করে এটি ৯০ কিলোমিটার পাইপ লাইন দিয়ে তা পাঠায় চট্টগ্রামে। এই ভাসমান টার্মিনালটি মহেশখালীতে এসে পৌঁছায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে।
পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প:
প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বিবিসিকে জানান প্রথম ইউনিটে ৬৬০ মেগাওয়াটের নির্মাণকাজ শেষ । আগামী পনেরই জানুয়ারি জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হবে । এরপর পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে মার্চ নাগাদ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
আর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষে মে মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হব। তবে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এর জন্য সরবরাহ লাইন তৈরির কাজ এখনো শেষ হয়নি।
পায়রা বন্দর:
বন্দরটির কার্যক্রম মোটামুটি মাত্রায় শুরু হয়েছে। পায়রা থেকে ঢাকা মুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬ মিটার গভীরতায় চ্যানেল ড্রেজিং সম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ বন্দর সুবিধা গড়ে তোলা।
চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে ১ হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল।
গত বছরের মার্চে ওই টার্মিনাল নির্মাণের ব্যয় প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ও সময় আরো দুই বছর বাড়ানো হয়।
আগামী ৩৪ মাসে তা শেষ হবে বলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর:
এর অগ্রগতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা শেষ করেছে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (পিসিআই)।
প্রাথমিকভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) ভিত্তিতে নির্মাণ করার কথা থাকলেও এখন গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) পদ্ধতিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। চীন, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ প্রাথমিক আগ্রহ দেখিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসব মেগা প্রকল্পের বাইরে ২০৩০ সালের মধ্যে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলছে। এগুলো হলে সরকারের আশা অন্তত এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং রফতানি আয় ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়:১৩৪৬ ঘন্টা ,০৪ জানুয়ারী ,২০২০
বাংলাপোস্ট/জামিল
সূত্র:বিবিসি