সামনে দীর্ঘ পথ চলা বাকি। কিন্তু ছোট্ট শরীর আর যে চলতে পারে না। পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরেছে ক্লান্তি। অগত্যা মায়ের হাতে ধরা সুটকেসের উপরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আর মা সেই চাকাওয়ালা সুটকেসে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন দলের সঙ্গে। ভারী সুটকেস আরো ভারী হয়ে উঠেছে সন্তানের ভারে। তবুও টেনে নিয়ে প্রাণপণ গতিতে হাঁটতে হচ্ছে ওই মহিলাকে। কেননা পিছিয়ে পড়লে দলছুট হয়ে যেতে পারেন।

ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার আরো এক নিদারুণ করুণ ছবি ফুটে উঠল এই দৃশ্যের মাধ্যমে। উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় একটি ছোট দলের অংশ ছিলেন এই মহিলা ও তার শিশু। কোথায় চলেছেন তারা? প্রশ্নের উত্তরে ওই মহিলা জান‌াচ্ছেন, ‘ঝাঁসি।’

কিন্তু রাজ্য সরকার তো লকডাউনের সময়ে পরিযায়ীদের শ্রমিকদের জন্য বাসের ব্যবস্থা তো করেছে। কেন তারা সেই বাসে উঠছেন না? উত্তর মেলে নাই। হাঁটতে হাঁটতে এতই ক্লান্ত মহিলা যে কথা আর আসে না মুখে। এদিকে দল যে এগিয়ে চলেছে। সুটকেসে ঘুমন্ত শিশু। অসহায় মা কেবল গতি বাড়াতে চান। ভারী হয়ে আসতে থাকে পা। দলটি হাঁটা শুরু করেছে পঞ্জাব থেকে। যেতে হবে ৮০০ কিলোমিটার দূরের ঝাঁসিতে।

মার্চের শেষ থেকে দেশব্যাপী জারি হওয়া লকডাউনের ফলে ভারতে চাকরি হারিয়ে খাদ্য-বাসস্থানের অভাবে পায়ে হেঁটে নিজের রাজ্যে ফিরতে বাধ্য হওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের যে কী পরিমাণ দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হচ্ছে তার নানা দৃষ্টান্ত গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সামনে এসেছে। সকলে অবশ্য হাঁটছেন না। কেউ কেউ সাইকেলে, কেউ বা ট্রাকে করে পাড়ি দিচ্ছেন দীর্ঘ দীর্ঘ পথ। এই দৃশ্য সেই তালিকায় নয়া সংযোজন সুটকেস।

চলতে চলতে পথে নুইয়ে পড়েছে কত শরীর। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হয়েছে। তবুও থামা নেই। জীবন যায় যাক, বাড়ি ফিরতে মরিয়া পরিযায়ীদের নামতেই হয়েছে পথে। গত ৮ মে মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদের ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন পরিযায়ী শ্রমিক। দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তিতেই তারা রেললাইনের উপরে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাস বা ট্রেন চালু করা হলেও যাঁরা এরই মধ্যে পথে নেমে পড়েছেন, তাতে তাঁদের বিশেষ লাভ হয়নি। পাশাপাশি অনেকের কাছেই টিকিটের দাম সাধ্যাতীত। আবার অনেকের কাছেই টিকিট কেনার টাকাও নেই। ফলে হাঁটা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায়ও নেই।

মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে একদল পরিযায়ী শ্রমিককে দেখা গিয়েছে, যারা লকডাউনের ফলে বেরিয়ে পড়েছেন রাস্তায়। ইট ভাঁটার এই কর্মীরা পরিবার-পরিজনদের নিয়ে প্রয়োজনে সাইকেলে চেপেই চেষ্টা করছেন বাড়ি ফিরতে। এক ভদ্রলোককে দেখা গেল দুই সন্তানকে সাইকেলে বসিয়েছেন। সেই সঙ্গে সাইকেলে বেঁধে নিয়েছেন বিছানাও! সামনে ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ। কঠিন যাত্রা। তবু পেরোতই হবে পথ। তার মতো করেই ভারতের অসংখ্য পরিযায়ীরাই নেমে পড়েছেন রাস্তায়। লকডাউনের স্থবিরতাকে মাড়িয়ে বাড়ি ফেরা— তাদের স্বপ্ন বলতে আপাতত এটুকুই।

সূত্র- এনডিটিভি।