অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

‘সারাবিশ্বে প্রতি ৪ জন মানুষের মধ্যে ১ জন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকেন, সেই ১ জন যেন আপনি না হন।’ – এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সম্প্রতি পালিত হল বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। মানুষকে সচেতন করে তোলাই এই দিবসের লক্ষ্য। অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে স্ট্রোক একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। রোগটি আসলে মস্তিষ্কের, অনেকেই একে হার্ট অ্যাটাক বলে ভুল করেন। মস্তিষ্কের রক্তবাহীনালীর দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালী বন্ধ বা ফেটে মস্তিষ্কের কোন অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত বা বন্ধ হয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে দ্রুত চিকিৎসা করা হলে মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং স্ট্রোক সংক্রান্ত অন্যান্য জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অনেক কারণেই স্ট্রোক হতে পারে, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ সবচেয়ে বড় কারণ। এছাড়াও অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি, ধূমপান, তামাক পাতা, জর্দ্দা, মাদক সেবন স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেকোনো ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন ও জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালী থাকা। বংশানুক্রমে কিংবা পূর্বের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালী বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ: হাঁটতে বা চলাফেরা করতে এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমস্যা, কথা জড়িয়ে যাওয়া এবং অস্পষ্ট শোনা। শরীরের যেকোনো একপাশ বা উভয়পাশ দুর্বল, অসাড় বা প্যারালাইজড,  চোখে অস্পষ্ট বা অন্ধকার দেখা ইত্যাদি। স্ট্রোকের মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে অজ্ঞান হওয়া, খিচুনি, তীব্র মাথা ব্যথা ও বমি।স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়: স্ট্রোক অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য।  আক্রান্ত রোগী নিজে মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিরোধ করাই সর্বোত্তম।  স্ট্রোকের ঝুঁকি সম্পর্কে জানা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলা উচিত। নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধূমপান, মদ্যপান, মাদক দ্রব্য, তামাক পাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। হৃৎপিন্ডের রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শারীরিক ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে ওজন কমানো, খাদ্যে পশুর চর্বি ও অধিক পরিমাণ লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানি, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত। শাকসবজি, অল্প ভাত, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যে কোন মাছ, বাচ্চা মুরগি ও ডিম খেলে কোন ক্ষতি হয় না।  নিয়মিত সুষম খাদ্য বিশেষ করে শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, ছোট মাছ, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি খান। নিয়মিত ব্যায়াম, সকাল-বিকাল হাটা চলা করা এবং অলস জীবন যাপন পরিহার করতে হবে। দুঃশ্চিন্তা বা টেনশনমুক্ত বা মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। নিয়মিত ধর্ম চর্চা এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মনে রাখতে হবে, স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া মানেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। রোগী একদিকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন আবার অন্যদিকে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলতে থাকে। স্ট্রোক ভয়াবহ হলেও একটু সচেতন হলে এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলেই এই রোগের কবল থেকে মুক্তি সম্ভব। লেখক : ইউ.জি.সি অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ,

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।