৫ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় শেষের পথে, তখন আগস্টের ৬ এবং ৯ তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বে সেই প্রথম কোন যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল এই গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র। মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।

(এই প্রতিবেদন এমন অনেক ছবি এবং তথ্য আছে, যা আপনাকে বিচলিত করতে পারে।)

হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে কত লোক মারা গিয়েছিল, তা মূলত আনুমানিক হিসেব। ধারণা করা হয় হিরোশিমা শহরের সাড়ে তিন লাখ মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ কেবল বোমার বিস্ফোরণেই মারা যায়। আর নাগাসাকিতে মারা যায় ৭৪ হাজার মানুষ।

কিন্তু পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে পরবর্তী সপ্তাহ, মাস এবং বছরগুলিতে আরও বহু মানুষ মারা গিয়েছিল।

এই বোমার শিকার হয়েও যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা “হিবাকুশা” বলে পরিচিত। তাদের ভয়ংকর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে বাকী জীবন বাঁচতে হয়েছে।

এই বোমা হামলার পর এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৪ই আগস্ট জাপান নিঃশর্তভাবে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

কিন্তু পরমাণু বোমার ভয়েই জাপান আত্মসমর্পণ করে বলে যে কথা বলা হয়, অনেক সমালোচক তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের মতে, জাপান এই বোমা হামলার আগে থেকেই আসলে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

A view of the devastation of Hiroshima after the atomic bomb
ধারণা করা হয় হিরোশিমার ১ লাখ ৪০ হাজার লোক বোমার বিস্ফোরণে সরাসরি মারা যায়।

ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লড়াই থেমে গিয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৭ই মে। এরপর মিত্র বাহিনী ২৮শে জুলাই জাপানকে আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দেয়।

তবে এই সময়সীমার মধ্যে জাপান আত্মসমর্পণ করেনি।

জাপানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মোট ৭১ হাজার সৈনিক নিহত হয়। এদের মধ্যে ১২ হাজার মারা যায় জাপানের হাতে যুদ্ধবন্দী অবস্থায়।

১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট জাপানি সময় ঠিক সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বি-২৯ বোমারু বিমান, যেটির নাম ছিল ইনোলা বে, হিরোশিমায় প্রথম পরমাণু বোমা ফেলে।

ইনোলা গে বিমানের ক্রুরা। এই বিমান থেকেই হিরোশিমায় বোমা ফেলা হয়।
,ইনোলা গে বিমানের ক্রুরা। এই বিমান থেকেই হিরোশিমায় বোমা ফেলা হয়।

বিশ্বে কোন যুদ্ধে পরমাণু বোমা ব্যবহারের এটাই ছিল প্রথম ঘটনা।

হিরোশিমায় যে বোমাটি ফেলা হয়েছিল, মার্কিনীরা তার নাম দিয়েছিল ‘লিটল বয়।’

এটির শক্তি ছিল প্রায় ১২ হতে ১৫ হাজার টন টিএনটির বিস্ফোরণ ক্ষমতার সমান।

পাঁচ বর্গমাইল এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল এটি।

হিরোশিমার শতকরা ৬০ ভাগ বাড়ি একদম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল
হিরোশিমার শতকরা ৬০ ভাগ বাড়ি একদম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল
Transparent line
বোমার শিকার এক মানুষের ছাপ স্থায়ীভাবে আঁকা হয়ে গেছে সিড়ির পাথরে
বোমার শিকার এক মানুষের ছাপ স্থায়ীভাবে আঁকা হয়ে গেছে সিড়ির পাথরে
Transparent line
হিরোশিমায় বোমায় পুড়ে যাওয়া এক নারী
হিরোশিমায় বোমায় পুড়ে যাওয়া এক নারী
Transparent line
হিরোশিমার ধ্বংসস্তুপে পাওয়া এক ঘড়ি। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক ৮ টা ১৫ মিনিটে
হিরোশিমার ধ্বংসস্তুপে পাওয়া এক ঘড়ি। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক ৮ টা ১৫ মিনিটে
Transparent line
হিরোশিমায় বোমা হামলার আগের (বামে নীচে) এবং পরের ছবি (উপরে ডানে)
হিরোশিমায় বোমা হামলার আগের (বামে নীচে) এবং পরের ছবি (উপরে ডানে)

কিন্তু জাপান তখনো আত্মসমর্পণ করেনি।

তিনদিন পর, ৯ই আগস্ট জাপানি সময় সকাল ১১টা ২ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি পরমাণু বোমা ফেলে নাগাসাকি শহরের ওপর।

বোমা হামলার পর হিরোশিমা (বামে) এবং নাগাসাকির (ডানে) আকাশে মাশরুম আকৃতির ধোঁয়ার কুন্ডলি।
বোমা হামলার পর হিরোশিমা (বামে) এবং নাগাসাকির (ডানে) আকাশে মাশরুম আকৃতির ধোঁয়ার কুন্ডলি।

নাগাসাকিতে যখন বোমা পড়েছিল, তখন রেইকো হাডার বয়স মাত্র নয় বছর।

ফটো সাংবাদিক লী কারেন স্টোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

“আমি তখন আমার ঘরের প্রবেশ পথে ঢুকেছি এবং আমার মনে হয় এক পা ভেতরে দিয়েছি। তখন হঠাৎ করে এটি ঘটলো।”

“এক তীব্র আলোর ঝলকানি এসে আঘাত করলো আমার চোখে। হলুদ, খাকি আর কমলার রঙের আলো, যেন এক সঙ্গে মিশে আছে সব রঙ।”

“কী ঘটছে সেটা বোঝার মতো সময় পর্যন্ত আমার ছিল না। মূহুর্তের মধ্যেই সবকিছু যেন সাদা হয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগলো, আমি যেন একদম একা, আর কেউ কোথাও নেই। এরপর একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। এরপর আমি জ্ঞান হারালাম।”

বোমা বিস্ফোরণের পর নাগাসাকির ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ীঘর।
বোমা বিস্ফোরণের পর নাগাসাকির ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ীঘর।

এই পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের পর মানুষ যেরকম মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল, তা দেখেছেন হাডা।

“অনেকেই কনপিরা পর্বতের ওপর দিয়ে আমাদের এখানে পালিয়ে এসেছিল। এদের অনেকের চোখ বেরিয়ে এসেছে, অনেকে প্রায় নগ্ন, অনেকের গায়ের চামড়া পুড়ে ঝুলে আছে।”

“আমার মা তাড়াতাড়ি তোয়ালে এবং চাদর নিয়ে আসলেন। তিনি আমাদের এলাকার অন্যান্য মহিলাদের সাথে নিয়ে পালিয়ে আসা লোকজনকে একটা কলেজের অডিটোরিয়ামের দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাদের শুইয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হলো।”

“এরা সবাই পানি চাইছিল। আমাকে বলা হলো ওদের পানি দিতে। কাজেই আমি একটা বাটি নিয়ে কাছের নদীতে গেলাম। সেখান থেকে তাদের পান করার জন্য পানি নিয়ে আসলাম।”

“এক ঢোক পানি খেয়েই তারা মারা গেল। একজনের পর একজন মারা যাচ্ছিল।”

বোমার পর বায়ু দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মুখোশ পড়েছে হিরোশিমার শিশুরা।
বোমার পর বায়ু দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মুখোশ পড়েছে হিরোশিমার শিশুরা।

জাপান নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে ১৪ই আগস্ট।

সেই একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্র্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান হোয়াইট হাউসের বাইরে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।

তিনি বলেন, “পার্ল হারবারে আক্রমণের পর থেকে এই দিনটির জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আজকের এই দিনে অবশেষ ফ্যাসিবাদের মৃত্যু ঘটলো, আমরা সব সময় জানতাম ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হবেই।”

এর পরদিন রেডিওতে জাপানের সম্রাট হিরোহিতোকে প্রথমবারের মতো রেডিওতে বক্তৃতা দিতে শোনা যায়।

এতে তিনি জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের জন্য “এক নতুন এবং নিষ্ঠুর বোমা”কে দায়ী করেন।

তিনি বলেন, “আমাদের যদি লড়াই চালিয়ে যেতে হয়, তা কেবল একটি জাতি হিসেবে জাপানের চুড়ান্ত পতন এবং ধ্বংসই ডেকে আনবে না, তা পুরো মানব সভ্যতাকেও সম্পূর্ণ নির্মূল করে দিতে পারে।”

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী মন্তব্য করেছিলেন, “আমাদের সর্বশেষ শত্রুকেও আমরা শেষ করে দিতে পেরেছি।”

তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিয়ে আরও বলেছিলেন, “তাদের বিস্ময়কর প্রচেষ্টা ছাড়া প্রাচ্যে যুদ্ধ আরও বহু বছর ধরে চলতেই থাকতো।”

বোমা হামলার এক বছর পরের হিরোশিমা
,বোমা হামলার এক বছর পরের হিরোশিমা

জাপানের আত্মসমর্পণের পর ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডায় বিজয় উৎসব করার জন্য দুদিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়।

১৫ই আগষ্ট যেদিন জাপানের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করা হয়, সেদিন মিত্র জোটের দেশগুলিতে লাখ লাখ মানুষ কুচকাওয়াজ এবং রাস্তায় রাস্তায় উৎসবে যোগ দেয়।

লন্ডনে বাকিংহাম প্রাসাদের ব্যালকনি থেকে রাজপরিবারের সদস্যরা উল্লসিত জনতার দিকে হাত নাড়েন।

জাপান আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল ২রা সেপ্টেম্বর।

টোকিও উপসাগরে থাকা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস মিসৌরিতে এই দলিল সই করা হয়।

বোমায় বিধ্বস্ত এক স্কুলঘরে ক্লাস চলছে ১৯৪৬ সালে
বোমায় বিধ্বস্ত এক স্কুলঘরে ক্লাস চলছে ১৯৪৬ সালে

নীচের ছবিতে যে গম্বুজটি দেখা যাচ্ছে, সেটি হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফেলার পর যে কটি ভবনের কাঠামো দাঁড়িয়ে ছিল তার একটি।

পরমাণু বোমা হামলার স্মারক হিসেবে এটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

The Atomic Bomb Dome in Hiroshima

এই গম্বুজটির অবস্থান হিরোশিমার শান্তি স্মারক পার্কে।

এটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বলে ঘোষণা করেছে।

Source :BBC