বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এর বাইরেও বিকল্প শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তেল নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ কমে যেতে পারে।
ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ শ্রমিক দেশের ফিরে এসেছেন। নতুন করে যাদের যাওয়ার কথা ছিল সেই সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
সম্ভাব্য নতুন গন্তব্য দেশ যেগুলো
সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মোঃ শামসুল আলম জানিয়েছেন নতুন যেসব দেশে সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া, উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান। এ ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকং এর কথাও ভাবা হচ্ছে।
তিনি বলছেন, “মরুভূমির চেয়ে এসব দেশে আবহাওয়া সহনীয়। তাছাড়া এসব দেশে কাজগুলোর ধরণ ভাল, শুধু ক্লিনারের কাজ না। বেতনও বেশি আবার শ্রমিকদের অধিকারের পরিস্থিতিও ভাল।”
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এরকম সংস্থা রামরু’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকি বিবিসিকে বলছিলেন, “২০২৫ সাল পর্যন্ত জাপান সারা বিশ্ব থেকে পাঁচ লাখ কর্মী নেবে। বাংলাদেশকে এই বাজারটা ধরতে হবে। যারা জাপানিজ ভাষা জানবে ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।”
তিনি আরও জানিয়েছেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে দুই হাজারের মত শ্রমিক বিদেশে কাজে গেছেন।
তার মধ্যে আটশই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের থেকে তারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। তবে সেখানে যেতে হলে কমপক্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা থাকতে হবে। ঠিক কি কাজে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা সেটি পরিষ্কার নয়।
যে ধরনের কাজের সুযোগ এসব দেশে
নারী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এরকম সংস্থা বিএনএসকে’র নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলছেন, “করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ইউরোপসহ বহু দেশে বিশেষ করে বয়স্কদের কেয়ার-গিভার বা সেবাদানকারীর চাহিদা অনেক বেড়েছে। শিশুদের দেখভালের জন্য আয়া দরকার হচ্ছে। বাংলাদেশের যেসব নারীরা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ করছেন তারা ইতিমধ্যেই এধরনের নার্সিং-এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।”
তিনি বলছেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বেশি তাই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি।
এসব দেশে প্রচুর বয়স্ক ব্যক্তি একা থাকেন অথবা বয়স্কদের কোন বিশেষায়িত আবাসনে থাকেন। যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যেই অনেক বাংলাদেশি নারী, বয়স্ক ও শিশুদের সেবাদানকারী হিসেবে কাজ করছেন।
সুমাইয়া ইসলাম বলছেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী, বিমানবন্দর, রাস্তা ও শপিং মলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন তারা খুব সহজেই হোটেলে নানা কাজ করতে পারবে।
“যে মেয়েটি মধ্যপ্রাচ্যে কারো বাড়িতে ঘর, বাথরুম আর কাপড় পরিষ্কার করে সে হোটেলেও হাউস-কিপিং-এর এসব কাজ সহজেই করতে পারবে। যারা করোনাভাইরাসের জন্য চাকরী হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন তাদের স্কিল ডাইভার্সিফাই করে সহজেই এসব পেশায় পাঠানো সম্ভব। দোকানে সেলসেও এসব মেয়েদের কাজে লাগানো যেতে পারে।”
তাসনিম সিদ্দিকি বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর একটি বিষয় স্পষ্ট সেটি হল পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মী দরকার। তার তথ্যমতে নার্স এবং ল্যাব টেকনিশিয়ানের চাহিদা রয়েছে প্রচুর।
তিনি বলছেন, পুরনো গন্তব্যগুলোতেও নতুন কাজের সুযোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে।
মোঃ শামসুল আলম জানিয়েছেন জাপানের সাথে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্বারক সই হয়েছিল।
‘আই অ্যাম জাপান’ নামে একটি কোম্পানি ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে।
তারা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে, কর্মী নির্বাচন করে জাপানে বিভিন্ন কোম্পানি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরির কাজ নিজেরাই শিখিয়ে নিয়োগ দিচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়াতে সরকারিভাবে ইতিমধ্যেই অনেকে গেছেন। বাংলাদেশি কর্মীদের সেখানে কাজের জন্য ইপিএস নামে বিশেষ ভিসা রয়েছে।
সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস প্রশিক্ষণ দিয়ে ইতিমধ্যেই অনেককে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়েছে যারা নানা কোম্পানি ও উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করছেন।
জাপানের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও নিজেরা ভাষা ও দক্ষতা তৈরি করে, খরচ দিয়ে বাংলাদেশে কর্মী নেয়।
মোঃ শামসুল আলম বলছেন, আরও কর্মী নিতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে স্যামসাং ও দাইয়ুর মতো প্রতিষ্ঠানের কারখানায় বাংলাদেশিরা কাজ করছেন। কৃষিতেও কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।
তবে তিনি বলছেন, নতুন দেশগুলোতে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।
“কেউ যেন দেশগুলোর নাম শুনেই যাওয়ার চেষ্টা না করে। কুচক্রী মহলের পাল্লায় পড়ে মানব পাচারের শিকার যেন না হয় এজন্য আমরা দেখে শুনে এগুচ্ছি।”
কি ধরনের দক্ষতা কাজ শিখলে লাভ
যে নতুন গন্তব্যের দেশগুলোতে সুযোগ রয়েছে সেখানকার ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন অভিবাসীদের নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সকলেই। সেই সাথে ইংরেজি।
তাসনিম সিদ্দিকি বলছেন, “যাওয়ার আগে কেবল দুই তিন মাসের ক্রাশ কোর্স করে কখনোই নতুন বাজার ধরা যাবে না। সেজন্য একদম স্কুল থেকেই অন্যান্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিতে ওরিয়েন্টেশন দরকার।”
বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা, যেমন ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী মেরামত, গাড়ি মেরামত, বৈদ্যুতিক কাজ এসব কাজের শিক্ষা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু করার কথা বলছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের যার যেটাতে আগ্রহ।
নার্স ও ল্যাব টেকনিশিয়ান তৈরিতে বেসরকারি খাতের সাথে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের প্রশিক্ষক কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
কৃষিকাজে যোগ দিতে হলে কৃষি যন্ত্রপাতি, গাছের আধুনিক উপায়ে পরিচর্যা, গাছ ও তার মৌসুম সম্পর্কে শিখানোর প্রশিক্ষণের কথা বলছেন তিনি।
source :BBC