অনলাইন ডেস্ক :
রাজধানী ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান হামলাকে বলা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলা।
শহরের দূতাবাস পাড়া ও কূটনীতিকদের আবাসনের এত কাছে একটি অভিজাত এলাকায় বিদেশিদের টার্গেট করে যেভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে এবং রাতভর রেস্তোরাটিকে ঘিরে যে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ছিল সে কারণে এই হামলা বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সক্ষমতা কতটা বেড়েছে?
এরপর থেকে জঙ্গিবাদ দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনেক ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি এবং শুধু জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করার জন্য নতুন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান বলছেন, তাদের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
তিনি বলছেন, “একটা হচ্ছে সরকারের জিরো টলারেন্স পলিসি ঘোষণা করা। স্পেশালাইজড ইউনিট তৈরি, যার ধারাবাহিকতায় অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট তৈরি হয়েছে। গোয়েন্দা সক্ষমতা, ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিস করার সক্ষমতা, সাইবার পেট্রোলিং অর্থাৎ অনলাইনে ও সোশাল মিডিয়াতে যেখানে তাদের বিচরণ বেশি সেখানে আমরা নিয়মিত নজরদারী করি। অপারেশন চালানোর ক্যাপাসিটি ও তদন্ত চালানোর সাপোর্ট এগুলো বহুগুণে বেড়েছে।”
তিনি আরও বলছেন, “যেহেতু জঙ্গিবাদ একটা বৈশ্বিক বিষয়, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্টতা ও আদানপ্রদান অনেক বেড়েছে।”
উগ্র-মতবাদের প্রসার ঠেকাতে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণদের সাথে জনসংযোগ করছেন ও মসজিদ ভিত্তিক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সাধারণ জনগণকে তথ্য দেয়ার ব্যাপারে সচেতন করছেন। এছাড়া যেসব অঞ্চলে জঙ্গি গোষ্ঠীর কার্যক্রম বেশি ছিল সেখানে নিয়মিত নজরদারি কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা।
জঙ্গি গোষ্ঠীর নতুন পদ্ধতি মোকাবেলা কতটা সম্ভব
হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি হামলারও আগে প্রায় দুই বছর ধরে জঙ্গিবাদ উত্থানের বেশ কটি বড় নমুনা বাংলাদেশ দেখেছে।
একের পর গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ভিন্ন মতাবলম্বী লেখক, ব্লগার, প্রকাশকসহ সমকামী অধিকার কর্মী, বিদেশি নাগরিক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু।
সেই পটভূমিতে ইসলামপন্থী জঙ্গিবাদের উত্থানের সবচেয়ে বড় নমুনা ছিল হোলি আর্টিজান হামলা।
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর টেরোরিজম রিসার্চ-এর প্রধান শাফকাত মুনীর। কাছাকাছি সময়ে তেমন হত্যাকাণ্ড বা বড় কোন হামলার অনুপস্থিতিকে জঙ্গিবাদ দমনে সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত বলে মনে করছেন তিনি।
তবে উগ্র মতবাদে বিশ্বাসীরা এখনো ছোটি ছোট গোষ্ঠীতে সক্রিয় যা পুলিশও স্বীকার করছে। অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান বলছেন, মাঝে মাঝে তারা ছোট আকারে অস্তিত্ব প্রকাশ করার চেষ্টা করছে।
শাফকাত মুনীর বলছেন, হামলা বা সক্রিয় থাকার জন্য এসব গোষ্ঠী নিয়মিত নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছে।
সেটি মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, “ছোট নেটওয়ার্ক বা গুপ্ত যে সেলগুলো রয়েছে, সেগুলোকে খুঁজে বের করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। উগ্র মতবাদের আকর্ষণ করার জন্য বা র্যাডিকালাইজেশনের যে পদ্ধতিগুলো আছে সেগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের সেই সাথে মনে রাখতে হবে সবসময় যে প্রথাগতভাবে জঙ্গি হামলা হবে সেটা কিন্তু না। কারণ জঙ্গি বা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কিন্তু প্রতিনিয়তই তাদের কর্মপন্থার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিবর্তন নিয়ে আসছে।”
উৎসবের ভিড়ের মধ্যে গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে বহু মানুষ হত্যা করা, পথচারীদের এলোপাথাড়ি ছুরি চালানো এমন কিছু নমুনা ইউরোপের দেশে দেখা গেছে।
বিশেষ করে ‘লোন উলফ’ বা জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর আদর্শের প্রতি অনুগত কোন ব্যক্তি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে যে হামলাগুলো চালায় সেটিও নতুন কায়দা।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রথাগত কৌশল?
হোলি আর্টিজান হামলাসহ বাংলাদেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডই কথিত ইসলামিক স্টেট ঘটিয়েছে বলে দাবী করেছে।
যদিও কখনোই বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বা তাদের সাথে স্থানীয় কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করেনি সরকার।
সরকারের তরফ থেকে সবসময় বলা হয়েছে এসব হামলা জন্য দায়ী দেশি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী যারা হয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামিক স্টেটের প্রতি অনুগত।
এর আগে হোলি আর্টিজান হামলার পর দুই বছরের বেশি সময় ধরে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম দমনে একের পর এক অভিযান চালিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে এক অর্থে কোণঠাসা করে ফেলেছে বলে দাবি করে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঢাকার কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেটের আতিয়া মহলের অভিযানে সহ এসব অভিযানে বেশ বড় সংখ্যায় তথাকথিত ইসলামপন্থী জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে।
জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করছেন সুইডেনে অবস্থানকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক তাসনিম খলিল।
তিনি বলছেন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, আন্ত-রাষ্ট্রীয় তথ্য আদান প্রদান, নজরদারি ও প্রযুক্তিগত দিকে বাংলাদেশের সক্ষমতা আগের চাইতে অনেক বাড়লেও, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের দমনে এখনো কিছু প্রথাগত কৌশল অবলম্বন করছেন যা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, “তারা অভিযান করে অনেককে মেরে ফেলেছে। কিন্তু এসব ব্যক্তির মধ্যে কানেকশন, এই আইসিসের মতো একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কিভাবে এত দ্রুত বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করলো সেটা কিন্তু তারা উদঘাটন করতে চাননি অথবা করতে পারেননি। এর কারণ হল ঘটনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের তারা মেরে ফেলেছেন।”
তিনি বলছেন, “সারা বিশ্বে আমরা যেটা দেখেছি রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তি প্রদর্শনের কায়দা জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ দমনে শেষ পর্যন্ত কাজে আসে না।”
বাংলাদেশ সময় :৫৫০ ঘন্টা ,২৮ নভেম্বর ২০১৯.
বাংলাপোস্ট /জামিল
সূত্র : বি বি সি