জাপানের ৮৭টি কোম্পানি চীন থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নিচ্ছে। জাপান সরকার কারখানা স্থানান্তরে কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করার জন্য যে তহবিল গঠন করেছিল, তার আওতায় এসব প্রতিষ্ঠান ভর্তুকি পাবে।
জাপানের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় গত শুক্রবার জানায়, এসব কোম্পানি সাত হাজার কোটি জাপানি ইয়েন সহায়তা পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
জাপান সরকার গত এপ্রিল মাসের শুরুতে ২৪ হাজার ৩৫০ কোটি জাপানি ইয়েনের (১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা) একটি তহবিল ঘোষণা করে, যার আওতায় চীন থেকে জাপানে ফিরে যেতে এবং চীন থেকে অন্য দেশে কারখানা সরিয়ে নিতে আগ্রহী জাপানি কোম্পানিগুলোকে সহায়তার কথা বলা হয়।
জাপানের অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় শুক্রবার প্রথম দফায় ৮৭টি কোম্পানিকে সহায়তার জন্য চূড়ান্ত করার কথা জানায়। ফলে এটি আনুষ্ঠানিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল, গুঞ্জন নয়।
জাপানিদের চীন ছাড়ার কারণ দেশটির ওপর নির্ভরতা কমানো। যেকোনো পণ্য সস্তায় ও কম খরচে তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত চীনে গত তিন দশকে ঘাঁটি গেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানি বহুজাতিকেরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। বেশির ভাগ চীনা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকতে ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্কের মুখে পড়ছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে, এককভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল থাকাটা কতটা বিপদের। তাই নিরাপত্তা ও কৌশলগত কারণেই চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য নিয়েছে জাপানিরা। ফলে শুরু হয়েছে সম্মিলিত প্রস্থান। আর এই প্রস্থানের সুফল বেশি পাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। বিশেষ করে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড।
জাপানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৮৭টি কোম্পানির ৫৭টি জাপানে ফিরে যাচ্ছে। আর ৩০টি চীন ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) ওয়েবসাইটে চীন ছেড়ে জাপানের বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকা দেওয়া রয়েছে।
সেই তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০টির মধ্যে ১৫টি কোম্পানি ভিয়েতনাম, ৬টি থাইল্যান্ড, ৪টি মালয়েশিয়া, ৩টি ফিলিপাইন, ২টি লাওস, ১টি ইন্দোনেশিয়া এবং ১টি মিয়ানমার যাচ্ছে (দুটি কোম্পানি কারখানা দুই দেশে নিচ্ছে)।
জাপান কারখানা সরাতে যে সহায়তা দিচ্ছে, তা মূলত আসিয়ানভুক্ত (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন) দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য। আঞ্চলিক এই জোটের সদস্য ১০টি দেশ—ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনেই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও লাওস। বিনিয়োগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আসিয়ান দেশগুলোকে অগ্রাধিকারে রাখে জাপান।
জাপানের বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরা হোল্ডিংসের এক জরিপ ও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে ফক্স নিউজ জানিয়েছিল, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ৭৯টি কোম্পানি চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি ভিয়েতনামে, ১১টি তাইওয়ানে, ৮টি থাইল্যান্ডে, ৬টি মেক্সিকোতে ও ৩টি ভারতে গেছে। বাংলাদেশ পেয়েছে ২টি।
বাংলাদেশও জাপানি বিনিয়োগ পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে জাপানিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো করপোরেশন। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। যদিও তাতে বেশ কিছু সেবা যুক্ত করা এখনো বাকি।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম গত ১২ মে জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছেন, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী। এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে আনুক। চীন থেকে সরে যাওয়া কারখানা এ দেশে আনতে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার চিন্তা করছে সরকারও। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে। অবশ্য নীতি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকায় বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, চীন থেকে কারখানা স্থানান্তর যে সুযোগ তৈরি করেছে, তা থাকবে দুই বছরের মতো। এ সময়ের মধ্যেই কোম্পানিগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে যে তারা কোন দেশে যাবে। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ কী কী নীতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা জানানোর দরকার ছিল গত এপ্রিলেই। আমরা চার মাস পিছিয়ে আছি। অন্যরা কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।’
বাংলাদেশে এখন জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ২৭০টির মতো। বিগত কয়েক বছরে হোন্ডা মোটর করপোরেশন, জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল, নিপ্পন স্টিল অ্যান্ড সুমিতমো মেটাল, মিতসুবিশি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। অন্য দেশগুলো যেভাবে জাপানি বিনিয়োগ পাচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে অনেক পিছিয়ে। এমনকি মিয়ানমারও বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকছে।
বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসাসূচক বা ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ৭০, থাইল্যান্ড ২১ ও ইন্দোনেশিয়া ৭৩তম। মিয়ানমারের অবস্থানও বাংলাদেশের তিন ধাপ আগে, ১৬৫তম।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বাংলাদেশকে আসিয়ানের পর্যবেক্ষক করার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বাজার ধরতে ও বিনিয়োগ টানতে বাংলাদেশের উচিত আসিয়ানের সদস্য হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। শামস মাহমুদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সবাই বিনিয়োগ করার জন্য বসে আছে, এই ধারণা পাল্টাতে হবে। বাস্তবতা হলো আরও অনেক দেশ বিনিয়োগের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করছে। তাই আমাদের আরও উদ্যোগী হতে হবে।’