কয়েক বছর আগেও কোনো কাগজপত্র ছাড়াই পাকিস্তানে যেতে পারত আফগানিস্তানের মানুষ। সেই ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষীদের সামান্য কিছু অর্থ দিলেই হতো।
মূলত চিকিৎসার জন্যই পাকিস্তানে যান আফগানরা। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। সীমান্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। নিরাপত্তাব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে। ফলে কাবুলে পাকিস্তানের দূতাবাসে দিন দিন ভিড় বাড়ছে ভিসাপ্রার্থীদের।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্ত ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটারজুড়ে। দেশ দুটির সীমান্ত বিভক্তকারী রেখাকে বলা হয় ডুরান্ড লাইন। ১৮৯৩ সালে স্যার মর্টিমার ডুরান্ড দুই দেশের মধ্যে ওই বিভক্তরেখা টেনে দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় উন্মুক্ত ওই সীমান্ত দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবাধে চলাফেরা করতে পারতেন সীমান্তে বসবাসরত উপজাতিরা। করতে পারতেন নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য। হয়েছে নানা ধরনের অপরাধও।
যদি নজরদারি না করা হয়, তাহলে এ রকম বেড়া অনর্থক হবে। কারণ, তারের বেড়া কেটে যদি যাতায়াত বজায় থাকে, তাহলে এই বেড়া একদিন আর থাকবে না।
পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের ব্যবসায়ী ইহসানউল্লাহ শিনওয়ারি উন্মুক্ত সীমান্তের স্মৃতিচারণা করেছেন—তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে আফগান শহর জালালাবাদে প্রায়ই মাছ ভাজা খেতে যেতেন। ওটা যে ভিন্ন কোনো দেশ, তা তাঁদের কাছে কোনো দিন মনেই হয়নি।
কিন্তু দুই দেশের সীমান্তের এই উন্মুক্ততা বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্বরাজনীতির আলোচনায় চলে আসে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাহিনীর আগ্রাসন শুরু হলে এই সীমান্ত দিয়েই বিদ্রোহীদের কাছে অস্ত্র-সরঞ্জাম সরবরাহ করত যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে হামলা চালায়, তখন ওই একই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে তালেবান নেতাদের আশ্রয় নেওয়ার খবর প্রকাশ পায়। যুক্তরাষ্ট্র-ভারতসহ অনেক দেশ পাকিস্তানের মাটিকে তালেবানের ‘নিরাপদ স্বর্গ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে। পাকিস্তানজুড়ে হেরোইন পাচারের বেশির ভাগ ঘটে এই সীমান্ত দিয়ে।বিজ্ঞাপন
কিন্তু ২০১৬ সালে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পার্বত্য অঞ্চল ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মরুভূমি বরাবর সীমান্তে বসতে থাকে কাঁটাতার ও লোহার বেড়া। বেশ কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক ‘সীমান্ত পারাপারের স্থান’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর বদলে সীমান্ত দিয়ে চলাচলের জন্য ১৬টি স্থানে আনুষ্ঠানিক তল্লাশিচৌকি বসানো হয়েছে। যদিও বিশাল ওই দুর্গম সীমান্তের পুরোটাজুড়ে বেড়া তৈরির কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। এটা হতে আরও কয়েক সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সরকার।
ওই সীমান্তে বেড়া নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশ দীর্ঘদিন ধরেই দূতিয়ালি করে আসছিল। তারা আশা করছিল, বেড়া দেওয়া হলে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা কমবে। আফগান সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাওয়ার কারণে অবশেষে পাকিস্তান সরকার সীমান্তে বেড়া নির্মাণের দিকে এগোয়। এটা করা ছাড়া ইসলামাবাদের হাতে আর কোনো উপায়ও ছিল না। এই বেড়া নির্মাণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। বেড়া তৈরির কারণে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবানের (টিটিপি) হামলা কমে গেছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের ব্যবসায়ী ইহসানউল্লাহ শিনওয়ারি উন্মুক্ত সীমান্তের স্মৃতিচারণা করেছেন—তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে আফগান শহর জালালাবাদে প্রায়ই মাছ ভাজা খেতে যেতেন। ওটা যে ভিন্ন কোনো দেশ, তা তাঁদের কাছে কোনো দিন মনেই হয়নি।
তবে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা এই বেড়ার সুফল নিয়ে সন্দেহে রয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই রকম স্থানে শুধু বেড়া নির্মাণ করলেই নিরাপত্তা বজায় রাখা যাবে না। একজন পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘যদি নজরদারি না করা হয়, তাহলে এই রকম বেড়া অনর্থক হবে। কারণ, তারের বেড়া কেটে যদি যাতায়াত বজায় থাকে, তাহলে এই বেড়া একদিন আর থাকবে না।’
সংশয়বাদীরা আরও মনে করছেন, নজরদারি করা না হলে শুধু বেড়া নির্মাণেই কমবে না সীমান্তজুড়ে গড়ে ওঠা চোরাকারবারি। তাঁরা আরও মনে করছেন, বেড়া না থাকার কারণেই যে আফগান তালেবানরা সহজেই সীমান্ত পারাপার করতে পেরেছেন, এমনটা নয়। পাকিস্তানের সেনারাও তাদের সহায়তা করেছেন।
যদিও আফগান সরকার এখনো ডুরান্ড লাইনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের কিছু অংশকে নিজেদের বলে দাবি করে। ফলে এই বেড়া নির্মাণের জন্য আফগান সরকার অখুশি। তবে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মোয়েদ ইউসুফ বলেছেন, এই বেড়া দুই দেশের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যও বাড়বে।
যদিও এই বেড়া দুই দেশের রাজনীতি বা অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, তা বুঝতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এর বাস্তবিক প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে সীমান্তের দুই পাশে বসবাসরত পশতুন উপজাতিদের ওপর। কারণ, এখন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে। ইচ্ছা থাকলেও সহজে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না তাঁরা। তবে ইউসুফের দাবি, পাকিস্তান খুব সহজেই ভিসা দিচ্ছে। খুব সহজেই আফগানরা পাকিস্তানে আসতে পারবেন। তিনি ওই প্রক্রিয়াকে ইউরোপের সীমান্তব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন।
তবে কাবুলে পাকিস্তানের দূতাবাসে ভিসার জন্য আসা আবদুল হক বারাকজাই ও অন্যান্য ভিসাপ্রার্থী বলেছেন, ভিসাপ্রাপ্তি খুবই কষ্টসাধ্য। এটি পেতে খুব ঝামেলা পেতে হচ্ছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট