আনুষ্ঠানিকভাবে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এর মধ্যে দিয়ে এক নেটওয়ার্কের আওতায় এলো দেশের সব সড়ক। গতকাল রবিবার ভোর ৬টায় সর্বসাধারণের যাতায়াতের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আর স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে উঠতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা।
জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনের পর ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদেরও ভিড় জমেছে পদ্মা সেতুতে। গতকাল রবিবার দিনের শুরু থেকে মাওয়া টোল প্লাজা এলাকায় দীর্ঘ সারি ছিল মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের। যারা টোল দিয়ে সেতুতে ওঠেন, তাদের মধ্যে ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। একই চিত্র জাজিরা প্রান্তেও। পণ্যবাহী ট্রাকের পাশাপাশি বাস, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের দীর্ঘ সারি ছিল সেখানে। বিভিন্ন স্থান থেকে দল বেঁধে বাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলে করে ঘুরতে আসেন পদ্মা সেতুতে। দলগতভাবে ছবি তোলেন টোল প্লাজা এলাকায়। অনেকে সেতুর ওপর গাড়ি থামিয়েও ছবি তোলেন। কেউ কেউ ফেসবুকে লাইভ দেন। অনেকে আবার যন্ত্রপাতি নিয়ে মন্তব্যও করেন। এ জন্য পদ্মা সেতুতে উৎসুক মানুষের হাঁটা-চলার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সেতু বিভাগ। তারা বলছে, সেতুর ওপরে এবং টোল প্লাজার আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল ও যন্ত্রপাতি আছে। উৎসুক মানুষের কেউ কেউ সেতুতে নেমে এসব মালামাল ও যন্ত্রপাতি চুরি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় সেতুতে মানুষের না নামার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অনুরোধ জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
গতকাল পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের সই করা চিঠি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট অ্যান্ড সেফটি টিমকে (ইএসএসটি) পাঠানো হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তায় নির্মাণকাজের শুরু থেকেই ইএসএসটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সময় কী পরিমাণ কমছে তার একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে- খুলনা থেকে গতকাল সকাল ৭টায় রওনা হন শাহাবুদ্দিন। মাত্র তিন ঘণ্টায় মাওয়া এসে পৌঁছান।
সারাদেশকে সড়ক যোগাযোগে এক সুতায় বাঁধার কাজটি আটকে ছিল পদ্মা নদীর কারণে। বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এ দুই অঞ্চলের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজন। তাই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করতে কোটি জনতার সময়ের দাবি ছিল পদ্মার দু-পারের সেতুবন্ধ। তার সুফল পেতে শুরু করেছে মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণের জেলা বরিশাল থেকে ঢাকায় আসতে অনেকটা সময় বাঁচবে। তবে কতটা সময় বাঁচবে, বাধাহীন যাত্রা করে কতটুকু সময়ে ঢাকা-বরিশাল যাতায়াত করা যাবে- এ নিয়ে একটা বিতর্ক ছিল। তবে অধিকাংশের মত ছিল- বাসে ঘণ্টা চারেকের মতো লাগবে।
বাস্তবতা হলো- চার ঘণ্টা নয়, তিন ঘণ্টারও কম সময়ে বরিশাল থেকে বাসযোগে ঢাকায় চলে এসেছেন সাইফুল ইসলাম। বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে রবিবার সকালে বাসে যাত্রা করে ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিটে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছান তিনি। আগে বরিশাল থেকে রাত ১০টায় ছেড়ে আসা কোনো বাস ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পরদিন ভোর ৪টা বেজে যেত। সে হিসাবে একজন যাত্রীর সময় ব্যয় হতো ৬ ঘণ্টা। আর বরিশাল থেকে রাত ৮টা ৩০ মিনিটে লঞ্চ ছাড়লে পরদিন ভোর ৪টার দিকে সেটি ঢাকার সদরঘাটে এসে পৌঁছায়। সে হিসাবে লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসতে সময় লাগে সাড়ে ৭ ঘণ্টার মতো।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে দক্ষিণের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হলো। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আশা করছেন, এখন ওই অঞ্চল থেকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য গন্তব্যে আরামদায়ক ও বিলাসবহুল বাস চালু হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে। মেঘনা সেতু, মেঘনা-গোমতী সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু ও ভৈরব সেতু নির্মাণের ফলে মধ্য, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সম্ভব হয়। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন উদ্বোধন হয় বঙ্গবন্ধু সেতু।
ওই বছর থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সরকারি অর্থায়নে প্রাক-সমীক্ষা করা হয় পদ্মা সেতু নিয়ে। ২০০৬ সালে রোড মাস্টার প্ল্যানে অন্তভুক্ত হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পটি। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্ত পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৫ জুন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের সড়ক এলো একই সুতায়।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশের বসবাস দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। বর্তমানে নদী পারাপারে রয়েছে ফেরি ব্যবস্থা, যাতে দীর্ঘসময় ব্যয় করতে হয়। ফেরি সার্ভিস মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশা এবং বন্যার কারণে বিঘিœত হয়। ফেরিগুলো ক্রমেই পুরনো হচ্ছে এবং ওভারলোডের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মিত হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার কমছে। মাঝপথে ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর চিত্র নেই। পদ্মা সেতু চালুর প্রভাব পড়েছে দৌলতদিয়া ঘাটে। ঘাটে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ কমেছে। এখন মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীসহ কয়েক জেলার যানবাহন দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবহার করছে। ফলে কোনো ভোগান্তি বা অপেক্ষা ছাড়াই দৌলতদিয়া ঘাটে আসা যানবাহনগুলো ফেরিতে উঠতে পারছে। আর শিমুলিয়া ও মাঝিরঘাট এলাকায় অপেক্ষারত বাস নেই।
২০০৫ সালে করা পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, মুন্সীগঞ্জের মাওয়া দিয়ে ফেরিতে ওঠার পর পদ্মা নদী পার হতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া দিয়ে লাগে ৩৫ মিনিট। মাওয়া ফেরিঘাটে যাত্রীবাহী যানবাহনকে গড়ে দুই ঘণ্টা এবং পণ্যবাহী যানকে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। অবশ্য ঈদ, বড় ছুটি অথবা শীতে ঘন কুয়াশায় ফেরিঘাটে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয় নদী পার হতে।
বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোও পদ্মা সেতু চালুর পর নতুন বাস নামাতে চাইছে। এর মধ্যে শরীয়তপুরের একটি নতুন কোম্পানি পাঁচটি রুটে বাস নামাতে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আবেদন করেছে। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে বৈঠক হয় কমিশনারের কার্যালয়ে। শরীয়তপুরের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ সূত্র। বিআরটিএ বাসের রুট দেওয়ার ক্ষেত্রে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে এবং ভাড়ার হার ঠিক করে দেয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, গাবতলী থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী বাসের অনেক কোম্পানি পদ্মা সেতু হয়ে বাস চালাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে চলতে হবে। এখন পর্যন্ত বিআরটিএতে এ বিষয়ে কোনো আবেদন আসেনি। বর্তমানে মাওয়া হয়ে ১৩টি রুটে বেসরকারি কোম্পানির বাস চলাচলের অনুমতি আছে। এর বাইরে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশাল ও কুয়াকাটা রুটে নতুন করে গ্রিন লাইন ও শ্যামলী পরিবহন বাস নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন থেকে বরিশাল রুটে বাস চালাতে চায় তারা। বিআরটিসি পদ্মা সেতু হয়ে ২৩ রুটে বাস চলাচলের সার্ভিস দিতে শুরু করেছে। চাহিদা বাড়লে বাসের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পথ ত্বরান্বিত করবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি। খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ‘গ্রস রিজিওনাল প্রডাক্ট’ মোট জিডিপির মাত্র ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যেখানে ঢাকা বিভাগের ৩৮ শতাংশ। সেতু নির্মাণের ফলে বার্ষিক ০.৮৪ শতাংশ দারিদ্র্য কমবে এবং জিডিপি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে।