করোনা প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে চলছে এক রকম স্থবিরতা। কাজ হারিয়ে শহর থেকে মানুষ ছুটছে গ্রামে। সেখানেও নেই কাজ। প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে অনেকের আয়। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ। কমেছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। তাই কৃষি উৎপাদন ভালো হলেও বিপণন হচ্ছে না আশানুরূপ।
ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একযোগে শুরু হওয়া ২৩ জেলার বন্যা। অন্যদিকে চলমান করোনায় আর্থিক সক্ষমতা হারিয়েছে এনজিওগুলো। তাই সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলোর। সব মিলিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেমে এসেছে এক রকম বিপর্যয়।
তবে বিদ্যমান সংকট মোকাবেলায় ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বাকি অর্থ এখনও বিতরণ শুরু হয়নি।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে সরকার ৪টি প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। প্রতিটি সংস্থাকে ৫০০ কোটি টাকা করে দেয়া হবে।
প্রায় ২ মাস আগে এসব অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলেও এখনও ছাড় করা হয়নি। তবে নিজস্ব অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত আকারে কিছু কর্মকাণ্ড শুরু করেছে।
এছাড়া গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিটি পরিবারকে ২ হাজার ৫শ’ টাকা করে তিন দফায় মোট সাড়ে ৭ হাজার টাকা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে মোট ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা।
তবে প্রথম কিস্তির টাকা বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হওয়ায় আপাতত এ কর্মসূচি বন্ধ আছে। এছাড়া সরকারের নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে ২ লাখ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। কাজ হারানো শ্রমজীবীদের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল বিতরণ করা হয়েছে।
এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর বড় একটি অংশই গ্রামে ব্যয় হবে। এছাড়া পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ১০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নাজুক অবস্থা চলছে। শহর থেকে মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন। এমনিতেই গ্রামে কাজের সংকট। ফলে সেখানে সংকট আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতি উন্নয়নে সময় লাগবে।
সাধারণ মানুষের কিছুটা কষ্ট মেনে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, দরিদ্রতার কারণে সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
জানা গেছে, গ্রামীণ অর্থনীতির মূলত তিনটি শক্তি। এগুলো হচ্ছে- শহর থেকে পাঠানো টাকা, কৃষি এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ (রেমিটেন্স)। কিন্তু শহরে বেসরকারি খাতে কাজ নেই। বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। কাজ হারিয়ে শহর থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন।
এতে গ্রামে সংকট বাড়ছে। এছাড়া এবার ফসল উৎপাদন ভালো হলেও তা গ্রামেই পড়ে আছে। এসব ফসল গ্রাম থেকে শহরে এনে বিক্রির প্রবণতা কমেছে। ফলে গ্রামে টাকা যাচ্ছে না। এরপর একসঙ্গে দেশের ২৩ জেলায় বন্যা চলছে। এতে এসব এলাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আর রেমিটেন্সে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও প্রবাসীদের একটি অংশের সঞ্চয়ের টাকা দেশে পাঠিয়ে দেয়া এবং হুন্ডি কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে রেমিটেন্স বেড়েছে। তবে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে চলে এসেছেন। ফলে এসব প্রবাসীর আয় নেই। সামগ্রিকভাবে যা গ্রামের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করেছে।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে আরোপিত লকডাউনের প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে স্থবিরতা নেমেছে তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। মানুষের চলাচল ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সবচেয়ে ক্ষতিতে পড়েছেন কৃষক। এর পাশাপাশি পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পও ক্ষতির মুখে পড়েছে।
গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অবস্থা এখন খুবই নাজুক। এতে একদিকে মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, অপরদিকে কমে গেছে আয়। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।
এ শ্রেণিটি গ্রামে গিয়ে আরও চাপ তৈরি করছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া ২৩টি জেলায় চলমান বন্যায় কৃষি ও মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
অর্থনীতি সমিতির তথ্য অনুসারে, ৬৬ দিনের লকডাউনে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এ সময়ে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামোয় পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন।
সংগঠনটির তথ্য অনুসারে করোনার প্রভাবে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। লকডাউনের আগে অতি ধনী যে ১ কোটি ৭০ লাখ ছিল তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ‘তবে উচ্চ-মধ্যবিত্তে থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্তে নেমে গেছে।
মধ্য-মধ্যবিত্তে থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ২ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্তে নেমেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা ৫ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছে। দরিদ্র থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ হতদরিদ্র হয়েছে। এ মানুষগুলো এক ধাপ নিচে নেমে গেছেন। এসব মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশই গ্রামে চলে গেছে।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সারা দেশে অঘোষিত লকডাউন শুরু হয়। এর প্রভাবে পণ্য বিপণন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলে কৃষকের উৎপাদিত সব পণ্য বিপণন করা সম্ভব হয়নি। এতে কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অনেকে পণ্য ফেলে দিয়েছেন।
একই অবস্থা তৈরি হয়েছে পোলট্রি খাতে। উৎপাদিত মুরগির বাচ্চা ও ডিম বিপণন করা সম্ভব না হওয়ায় এগুলো খামারিরা পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সাভার এলাকায় এসব ছিল পরিচিত দৃশ্য। ডেইরি শিল্পে উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে না পেরে খামারিরা সেগুলো যেমন গ্রামে পানির দামে বিক্রি করেছেন। অনেকে বিক্রি করতে না পেরে তা রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। করোনার গ্রামীণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এসব পণ্যের বিক্রি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে উৎপাদনও কমেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নগদ টাকার জোগান নিয়ে আসে পর্যটন শিল্প।
করোনায় পর্যটন শিল্প এখন বন্ধ। ফলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা মারাত্মক সংকটে পড়েছে। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশই কৃষি, বনজ ও মৎস্য খাতে নিয়োজিত। এ শ্রেণিটিই এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যায়। বাণিজ্য, হোটেল রেস্টুরেন্ট খাত রয়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ।
এর একটি বড় অংশই রয়েছে গ্রামে। গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। আদায় কমেছে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ।
এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই সময়ে এ খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। আদায় হয়েছিল ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে চলতি অর্থবছরে ঋণপ্রবাহ ও আদায় ব্যাপকভাবে কমেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ে কৃষি ও পল্লী ঋণ কর্মসূচির আওতায় ঋণ বিতরণ করেছে ১৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ২০ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ বিতরণ কমেছে ১ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছে ১৮ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ২০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ আদায় কমেছে ২ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।
এদিকে শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়ার কথা থাকলেও এর হার খুব কাছাকাছি আছে। শহরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। গ্রামে এ হার ৬ দশমিক ০২ শতাংশ। তবে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম।
এর মধ্যে শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ, গ্রামে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং গ্রামে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে মোট টাকার প্রবাহের মধ্যে ৮০ শতাংশই জোগান দেয় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো।
বর্তমানে এমআরএর (মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি) নিবন্ধন নিয়ে মাঠপর্যায়ে ৭৫৯টি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে। প্রতি মাসে তারা গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। এর ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ আদায় হয়।
এ হিসাবে মাসে ১১ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায় হয়। গত ৪ মাস ধরে কিস্তি আদায় বন্ধ থাকায় এসব অর্থ আদায় হচ্ছে না। ফলে লেনদেনও হচ্ছে না।
ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় অনেকে গ্রাহক এখন কিস্তি দিতে পারছেন না। ইতোমধ্যে নতুন ঋণ কর্মসূচি চালু হলেও হাতেগোনা বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল সংকটে ঋণ দিতে পারছে না।