বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কোভিড-১৯ নামের এই রোগে প্রধানত ফুসফুস আক্রান্ত হয়।
এ কারণে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে চিকিৎসার পাশাপাশি ফুসফুসের ব্যায়াম করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বেশ কয়েকবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ঘরে থেকেও যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, যারা আক্রান্ত হয়েছেন বা শনাক্ত হয়েছেন, তারা বিশেষভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে নজর দেবেন।
”এসময়ে আপনারা ফুসফুসের ব্যায়াম বা শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়ামটা নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাবেন। কারণ, অনেক সময়ই কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়ামটা যেন নিয়মিতভাবে চালিয়ে যান।”
”গভীরভাবে শ্বাস নেয়া এবং গভীরভাবে শ্বাস ছাড়া-এই প্রক্রিয়ায় ফুসফুসের ব্যায়াম করতে পারি। এভাবে ফুসফুসের ব্যায়াম করে ফুসফুসকে অনেক বেশি সক্রিয় রাখবেন”বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক।
যেভাবে করোনাভাইরাসে শনাক্ত ব্যক্তিরা ফুসফুসের ব্যায়াম করতে পারেন
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা খানম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় বা আইসিইউতে যেতে হয়, তাদের ফুসফুসের ক্ষতিটা বেশি হয়। তাদের সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে, স্বাভাবিক জীবনযাপনে যেতে অনেক সময় লেগে যায় বলে আমরা দেখেছি। তাদের জন্য পরবর্তীতে ‘ফুসফুসের পুনর্বাসন প্রোগ্রাম’ দরকার হয়ে পড়ে।”
তবে যারা বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তারাও চাইলে পুনর্বাসনের এসব ব্যায়াম করতে পারেন।
ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখা- এরপরে আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়তে হবে। এরফলে ফুসফুসের কোষগুলোর ব্যায়াম হয়, ফলে সেটির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে না।
এজন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, পিঠ সোজা করে আরাম করে বসতে হবে। এরপর প্রথমে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস দিয়ে ফুসফুসের সব বাতাস বের করে দিতে হবে। এরপর আবার গভীর শ্বাস নিয়ে যতটা সম্ভব ফুসফুসে বাতাস ভরে নিতে হবে।
এরপর যতক্ষণ সম্ভব হয়, শ্বাস আটকে রাখুন। এরপর আবার একসাথে সব বাতাস বের করে দিন। এভাবে দিনে অন্তত দুইবার এইরকম ব্যায়াম করা যেতে পারে। এতে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ ডা. আলতাফ হোসেন সরকার বলছেন, লম্বা শ্বাস নিয়ে বুক ফুলিয়ে কমপক্ষে ১০ সেকেন্ড ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। ১০ সেকেন্ড বোঝার জন্য একহাজার এক, এক হাজার দুই, একহাজার তিন…এভাবে দশ পর্যন্ত গোনা যেতে পারে।
প্রথমদিনে হয়তো এতটা করা যাবে না। কিন্তু আস্তে আস্তে একসেকেন্ড, দুই সেকেন্ড করে বাড়াতে হবে।
ইনসেন্টিভ স্প্যারোমেট্রি এক্সারসাইজ
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা খানম বলছেন, হাসপাতালের রোগীদের পাশাপাশি আউটডোরের রোগীদের জন্যও এই ব্যায়ামের সুপারিশ করা হয়।
এখানে ছোট্ট একটা ডিভাইসের মধ্যে তিনটা বল থাকে। শ্বাস দিয়ে রোগীদের সেই বলগুলো ডিভাইসের ভেতরে তুলতে হয়। প্রথমদিন হয়তো একটা, পরের দিন আরেকটা, এভাবে আস্তে আস্তে বল তোলার ক্ষমতা বাড়ে।
তিনটা বল তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে আবার ছেড়ে দি হয়। এভাবে ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ে।
উপুড় হয়ে ঘুমানো
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা খানম বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরে অনেক সময় অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হয়। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেই এটা হয়।
এজন্য উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে বা পাশ ফিরে শুয়ে থাকলে শরীরের অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ে।
এভাবে শুয়ে থাকার সময় মাথার নীচে কোন বালিশ ব্যবহার না করাই ভালো।
তবে বুক বেশি ভার ভার মনে হলে বা শ্বাস নিতে বেশি কষ্ট হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, বলছেন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা খানম।
শ্বাস নেয়ার সময় হাত তোলা
ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ ডা. আলতাফ হোসেন সরকার বলছেন, ”আমরা অনেক সময় রোগীদের পরামর্শ দেই যে, যখন শ্বাস নেবো তখন হাত ওপরে তুলতে হবে, আবার যখন শ্বাস ছেড়ে দেবো, তখন হাত নীচে নামিয়ে আনা হবে।”
এর ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরের অঙ্গের একটি ব্যায়াম হবে।
আবার লম্বা শ্বাস নেয়ার সময় বুকের পাঁজরের নীচে হাত রেখে অনুভব করতে হবে যে, বুকটা বেলুনের মতো ফুলে উঠছে। এরপর সেটা আবার চাপ দিয়ে বাতাস বের করে দিতে হবে। এভাবে দিনে অন্তত কয়েকবার করতে হবে।
নাক বন্ধ করে শ্বাস নেয়া
হাত দিয়ে প্রথমে নাকের বাম পাশ বন্ধ করে ডান পাশ দিয়ে লম্বা শাস নিন। ৫/১০ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখুন। এরপর শ্বাস ছেড়ে দিন।
এরপর নাকের ডান পাশ চেপে ধরে একই ভাবে শ্বাস নিন। একইভাবে ৫/১০ সেকেন্ড ধরে রেখে শ্বাস ছেড়ে দিন। এভাবে প্রতিদিন কয়েকবার করে অভ্যাস করুন।
বাষ্প নেয়া
ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ ডা. আলতাফ হোসেন সরকার বলছেন, অনেক সময় আমরা রোগীদের বাষ্প নেয়ার পরামর্শ দেই।
বাসায় থেকে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তারা গরম পানির ভাপ নিতে পারেন। সেটাও ফুসফুসের জন্য ভালো।
ব্রিটিশ লাং ফাউন্ডেশনের পরামর্শ হলো, গভীর শ্বাসের ব্যায়াম ফুসফুস থেকে শ্লেষ্মা দূর করে অধিক বায়ু সঞ্চালনে সাহায্য করতে পারে। এ ব্যায়াম করতে ৫-১০ বার গভীর শ্বাস নিতে হবে। তারপর কয়েক বার জোরে কাশি দিয়ে রিপিট করতে হবে। এতে ফুসফুস আরও শক্তিশালী হবে।
ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়াতে করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার পর খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলে হাঁটা শুরু করে শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পরবর্তীতে হাঁটার গতি আরো বাড়াতে হবে।
এসব ব্যায়াম স্বল্পমেয়াদী কোন ব্যায়াম নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যায়ামের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
যেসব ক্ষেত্রে এসব ব্যায়াম করা যাবে না
যদিও ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়াতে চিকিৎসকরা ব্যায়ামের পরামর্শ দিচ্ছেন, কিন্তু কারো যদি শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা বা কাশি থাকে, তখন এই ধরণের ব্যায়াম না করাই ভালো।
যাদের হৃদরোগ বা ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ রয়েছে, তারা ব্যায়ামের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
ব্যায়াম করার সময় অসুস্থ বোধ হলে বা শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়াম বন্ধ করে বিশ্রাম নিন। কষ্ট বেশি হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।