লিপন মুস্তাফিজ

অামি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন থেকেই বই পড়া শুরু করি । আমার মনে আছে “কুয়াশা” আর “দস্যু বনহূর” দিয়ে আমার গল্পের বইয়ের জগতে প্রবেশ। এরপরে ক্লাস এইট বা নাইনে যখন পড়ি তখন আমরা কাছাকাছি তিন বন্ধু থাকতাম । একসাথে স্কুলে যেতাম আবার টিফিনে বাসায় খেতে আসতাম , ছুটি হলে ফিরে আসতাম একসাথে । বিকেলে মাঠে খেলতাম। আজান দিলে যার যার বাড়ি চলে আসতাম। শুক্রবারে মসজিদে নামাজে যেতাম এক সাথে, এক কাতারে নামাজ পড়তাম । এখন আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি তাদের সন্তান কি এই সকল সুযোগ পাচ্ছে ? কিম্বা ফেলে আসা সেই ছোট্ট শহরে?

সেই সময় স্কুলের পাঠ্য বই থেকে গল্পের বইয়ের প্রতি আমাদের টান বেশি ছিল। আমরা তিন বন্ধু ছিলাম । তিনজনের এক বন্ধুর ছবি আঁকাতে ঝোঁক ছিল, আমি গল্পের বইয়ের প্রতি ঝুঁকে ছিলাম, আর অন্য বন্ধুর ছিল পাঠ্য পুস্তকে ঝোঁক। যে কিনা পরে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল। সে এখন জাপানে বসবাস করে স্থায়ীভাবে । আর আমি পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছি ১২ বছর আগে। আর একজন পথিযশা চিত্রশিল্পী।

আশির দশকের শেষের দিকে আমরা তখন কিশোর ক্লাসিক, রহস্য পত্রিকা, তিন গোয়েন্দা, রিডার ডাইজেস্ট, ইত্যাদি বই পড়তাম। যেহেতু ঢাকার বাইরের জেলা শহরে থাকতাম তাই এগুলো প্রকাশের কিছুদিন পরে আমরা স্থানীয় বইয়ের দোকানে পেতাম। দোকানগুলো আবার বাসার কাছে না, সাইকেলে চড়ে খোঁজ নিতাম দোকানে বা বইঘরে। এভাবে যারা বইয়ের দোকানী ছিলেন তাদের সাথে আমাদের সখ্যতা ছিল। অনেক সময় তারা ভালো কিছু বই আমাদের হাতে তুলে দিতেন পড়ার জন্য।

তখন সেবা বা অবসর প্রকাশনীর বইয়ের দাম ছিল ছয় থেকে আট টাকা, আমরা তিনজনে মিলে চাঁদা দিয়ে বই কিনতাম । আগেই ঠিক করে নিতাম, পালা করে বই পড়া হলে কে কোনটা নেবে। এভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর সংগ্রহ সম্মৃদ্ধ হত। আমাদের পঠিত গল্পের বইয়ের সংখ্যা বাড়ত। ফলে আমাদের স্কুল বা পাড়া বা এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ার বই পড়ুয়াদের মধ্যে এক ধরনের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেত। এমনও হতো একটা বই আমি নিলাম অন্যজন আমার কাছ থেকে বই নিত । এভাবে নিজের বইয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতাম কখনো কখনো। আবার বই হারিয়ে ফেলার কষ্টও আছে আমাদের বই পড়ার গল্পে। ঈদ সংখ্যা, শারদীয় সংখ্যা, লিটল ম্যাগাজিন বের হত , সেগুলোও পড়ার চেষ্টা করতাম, ধার করে বা কিনে। যদিও তখন বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা বের করা এখনকার মতন এত সহজ ছিল না।

পাড়ায় মহল্লায় অনেক সাহিত্য চর্চা হত, নাটক, বিভিন্ন দিবসে বড় ভাইয়েরা মিলে আয়োজন করতেন, কিন্তু এখন হয়ত কিছু চর্চা হয়ে থাকে কিন্তু রাজনীতিতে যারা আছেন তারা এ গুলা আয়োজন করে থাকেন। তাদের শিল্প , সাহিত্যবোধ থাকুক বা না থাকুক তার এর ক্রীম খেতে আসেন। আর আসেন লোক দেখাতে। এভাবেই ভাল মানুষ সংগঠক হারিয়েছে অনেক আগেই। আর যার বর্তমানে ভাল চিন্তা করেন তারা আর কোন উদ্যোগ নিতে চান না মান সম্মানের ভয়ে। এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের এলাকা ভিত্তিক সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ হয়েছে প্রায়। আমাদের সুমুকার বৃত্তিগুলো আজ মৃত । কাফনের সাদা কাপড়ে আবৃত। যার ফলে আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় হই দেশপ্রেম থেকে না , নিজের ফায়দার জন্য। সে সময় যারা বাম ছাত্র রাজনীতি করতেন তাদের পড়াশোনা ছিল অনেক বেশী ।

বুয়েটের একজন শিক্ষক যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু একদিন তাদের শিক্ষক কেন্টিনে চা খেতে খেতে বলছিল কোরিয়ায় সে পিএইচডি করতে গেলে তাদের ওরিয়েন্টেশনের দিন একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে টিভিস্ক্রীন ছাড়া আর কিছু নেই , বলে দেয়া হয় তোমাকে আমরা সার্বক্ষণীক মনিটর করছি, করব। তোমার পায়ের প্রতিটি ছাপ দেখতে পারব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা প্রসাশন চালান তারাও তো অনেকে অনেক দেশ থেকে পড়া লেখা করেছেন তারা কি পারেন না এই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে ? ফলে কোথায় কি হচ্ছে তা আমাদের জানতে বেগ পেতে হবে না।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলোকে মূল দলের রাজনৈতিক নেতারা নিয়ন্ত্রণ করেন। ছাত্ররাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি চলে। এটি বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতা দরকার।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অস্থিরতা চলছে, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ী করেন তিনি।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে যে ধারা চলছে, তাতে ছাত্রসংগঠনগুলোকে মূল দলের অনুগত হতে হয়। এই ধারার ছাত্ররাজনীতিতে অব্যবস্থাপনা, দুর্বৃত্তায়ন, টেন্ডারবাজি, ক্ষমতাকে উপভোগ করার সব বিষয় চলে আসে। ক্ষমতা প্রদর্শন ছাত্ররাজনীতিকে নষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। আমার মতে রাজনীতি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে দরকার ? বিশ্বের অন্য দেশে ছাত্র রাজনীতি ছাড়া কি নেতা তৈরি হচ্ছে না? যখনি ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা আসে তখন একটা কথা চলে আসে আমাদের সময় , তাহাদের সময়ের গল্প, কিন্তু আসলে এই সময়ের গল্পের কথা ভেবে অতীতের কথা না টেনে ছাত্র রাজনীতি চর্চার আদৌ দরকার আছে কিনা তা না ভেবে বন্ধ করে দেয়া দরকার। রাজনীতি এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছে , এসেছে স্কুলেও। সেদিন একজন বিচারপতির স্ত্রী বলছিলেন তার ছেলে স্কুল লীগে নাম লিখিয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে সে হয়ত স্কুল দলে যোগ দিত। আমার কথা হল বিশ্ববিদ্যালয় হল পড়া লেখা করার স্থান, এখানে রাজনীতি কেন করব?

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী একটি পত্রিকায় বলেন, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় বুয়েটে শিক্ষার পরিবেশের উন্নতি হবে, বুয়েটের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।
বুয়েটের মতো দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতি না থাকার কথা তিনি বলেন তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্ররাজনীতি ভালো কিছু বয়ে আনেনি। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্র ও শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন । এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একটা সার্বিক শিক্ষার পরিবেশের উন্নতি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন শিক্ষাকার্যক্রম আরও মজবুতভাবে। লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, ৩য় ব্যাচ, অর্থনীতি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।