বাংলাপোস্ট২৪ ডেস্ক:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ তারা করছেন সেই ব্যাপারে প্রমাণ দিতে না দিতে পারলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।

বেশ কয়েক সপ্তাহ জুড়ে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অপসারণের দাবিতে জোরালো আন্দোলন চলছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর এমন কড়া বক্তব্য এলো।

সরকারের বক্তব্য কী?

যে দুর্নীতির অভিযোগকে ঘিরে এই আন্দোলন সেটি নিয়ে প্রথম আলোড়ন শুরু হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি।

অভিযোগটি ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবি করেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা।

উপাচার্যও তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিলো।

তার কদিন পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সংগঠন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

এখন সরকারের পক্ষ থেকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে আন্দোলনকারীদের।

সকালে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেখানে কোন টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে কিভাবে দুর্নীতি হল? কোথায় টাকা গেলো সেটাতো আমরাও জানতে চাই। আন্দোলনকারীদের সুনির্দিষ্ট করে করে বলতে হবে কোথায় টাকা গেলো। মিথ্যা অভিযোগ করলে আমাদের প্রচলিত দণ্ডবিধি অনুসারে সেটার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবো আমরা।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুশিয়ারি দিয়েছেন যে দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ দিতে না দিতে পারলে শাস্তি।

অভিযোগ ওঠার পর ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের তাহলে কেন সরিয়ে দেয়া হল সেই প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সেখানে দুর্নীতি করবার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছিলো। আইনের ভাষায় দুটি বিষয় আছে ফৌজদারি অপরাধে কাউকে দণ্ডিত করার জন্য। একটি হল, মানসিক বিষয় আর অন্যটি হল ‘একটাস রিয়াস’, অর্থাৎ অপরাধ করা, যেটা অ্যাক্টিভলি করা হল। তো এখানে পয়সাই যেখানে ছাড়া হল না সেখানে অপরাধ কিভাবে সংঘটিত হলো?”

তার কাছে আরও প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো, দুর্নীতি করার পরিকল্পনাও যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটাও কী তদন্ত করে দেখা দরকার নয়কি?

মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, “যারা অভিযোগ করছে তারা প্রমান দিক। অভিযোগতো কেউ দিচ্ছে না। “

উপাচার্য কেন এখনো সরকারের সমর্থন পাচ্ছেন?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

গতকাল বিকেলের মধ্যে হল ছাড়ার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ছাত্র শিক্ষকদের একটি অংশ সেখানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এর মধ্যেই উপাচার্যকে তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। সেখানে তারা ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

আন্দোলনকারীদের ‘শিবির কর্মী’ বলে আখ্যা দেন উপাচার্য। এবং তিনি ছাত্রলীগকে তাকে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানান।

মিছিল
হুশিয়ারি সত্ত্বেও ছাত্র শিক্ষকদের একটি অংশ সেখানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই সবকিছুর প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম সরকারের সমর্থন পাচ্ছেন কিনা।

শিক্ষাবিদ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর ভিপি মাহফুজা খানম বলছেন, “বাংলাদেশে শিক্ষকরাও রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন। তারা সরকারের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়েই ওই পদে যান। রাজনৈতিক দলের যেসব এজেন্ডা থাকে তারাও সেগুলো প্রমোট করে।”

তিনি অভিযোগ করে বলছেন, “প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলর কিভাবে হবেন তার একটি নিয়ম নীতি আছে। সিনেটের একটি প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভিসি করেছেন। আর তিনি গতকাল যখন ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ দিলেন সেটি খুবই দু:খজনক।”

আন্দোলনকারীদের একজন পরিবেশ বিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেজিনা আহমেদ বলছেন, “যেহেতু আমাদের দুর্নীতির প্রমাণ দিতে বলা হয়েছে আর ছাত্রলীগের আক্রমণ থেকেও স্পষ্ট যে সরকার ভিসির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ভিসির সাথে ফোনালাপ যেখানে ফাঁস হয়েছে তারপরও আলাদা করে আমাদের প্রমাণ দেয়ার কী আছে?”

অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলছেন, “সরকারের ব্যাকিং দেয়া বা না দেয়ারতো এখানে কোন প্রশ্ন নেই।”

উপাচার্যের ফারজানা ইসলামের যা বক্তব্য

বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলনের পেছনে আসলে কত লোক আছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম।

তিনি বলছেন, ” হয়তো এক বা দুই পার্সেন্ট শিক্ষক শিক্ষার্থী এখানে এটি করছে। এরা কোন সমিতি নয়। এরা কোন নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়। এরা হঠাৎ কতগুলো মানুষ জড়ো হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা ভাবে অস্থির করে তুলেছে।”

তিনি বলছেন, “আমার যদি পদত্যাগ করতে হয়, তাহলে জোরালো ঘটনা লাগবে, জোরালো প্রমাণ লাগবে।”

শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন।
শিক্ষার্থীরা আজও উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন।

তিনি এর সাথে আরো বলেন, “সরকার শিক্ষামন্ত্রীকে দিয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন যে সাত তারিখের মধ্যে আপনারা যুক্তিসহ, অকাট্য প্রমাণসহ, অভিযোগ দিন। আমি ব্যবস্থা নেবো। প্রয়োজনে আমরা তদন্ত করবো, তখন যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন আমরা তার ব্যবস্থা নেবো। এত বড় কথা বলার পরেও তারা অভিযোগ-পত্র তৈরি করার বদলে এখানে বসে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।”

তিনি অভিযোগ করছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা এসে এখানে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে।

তিনি আরও বলছেন, “যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ সেখানে ছাত্রলীগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না অথচ বাইরের লোক এসে রাজনীতি করে যাবে এটা কতটুকু যৌক্তিক সেটাও চিন্তা করতে হবে।”

অনেক ক্যাম্পাসে অস্থিরতা

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আজও উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন। সেখানে তারা তার ভবনের সামনেই প্রতিবাদ কনসার্ট করার ঘোষণা দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আরও অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

গত কিছুদিন যাবৎ নানা দাবিতে একটির পর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হয়েছে।

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে।

গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের মুখে সরে গেছেন সেখানকার উপাচার্য।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সেখানেও এখনো অচলাবস্থা কাটেনি।

দেখা যাচ্ছে প্রায় সবগুলো আন্দোলন হচ্ছে উপাচার্যকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশ সময় :৮০০ ঘন্টা ,০৮নভেম্বর ১৯
বাংলাপোস্ট২৪/ জামিল